❏ ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ)
ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যে
সমস্ত তাফীর শাস্ত্রজ্ঞ, মুহাদ্দিস, মুয়াররিখ, ফকীহ, ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, তত্ত্ব ও শাস্ত্রালোচনায়
বিপুল পারদর্শিতা ও সর্বতোমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়ে এই মর-জগতের বুকে অমরত্ব লাভ
করেছেন এবং যেসব মনীষী পবিত্র কুরআন। হাদীস তথা শাশ্বত সুন্নাহর বিজয় নিকেতন
সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন, তন্মধ্যে হাফিয ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল ইবনু কাসীরের নাম
বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
❏ নাম ও বংশ পরিচয়ঃ
তাঁর প্রকৃত নাম ইসামঈল, আবুল ফিদা তাঁর কুনিয়াত
বা উপনাম এবং ইমাদুদ্দীন (ধর্মের স্তম্ভ) তাঁর উপাধি। সুতরাং তার ‘শাজরা-ই-নাসাব' বা কুলজীনামাসহ পুরো নাম
ও বংশ পরিচয় হচ্ছে নিম্নরূপঃ
আবুল ফিদা ইমাদুদ্দীন
ইসমাঈল ইবনু উমার ইবনু কাসীর ইবনু যাউ ইবনু কাসীর ইবনু যারা১, আল-কারশী২, আল-বাসারী, আদ্ দিমাশকী।।
কিন্তু সাধারণ্যে তিনি
ইবনু কাসীর নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। বস্তুতঃ ‘আল-বাসরী’ নামক তাঁর এই ‘নিসবাত’টি হচ্ছে জন্মস্থান বাচক
উপাধি এবং ‘আদ্ দিমাশকী’ নামক তাঁর এই ‘নিসবাত’টি হচ্ছে তাঁর
শিক্ষা-দীক্ষা বা তা'লীম ও তারবিয়াত বাচক
উপাধি ।
ইমাম ইবনু কাসীর ছিলেন এক
সুশিক্ষিত, জ্ঞানী ও বিদ্বান
পরিবারের সুসন্তান। তাঁর সুযোগ্য পিতা শাইখ আবু হাফ শিহাবুদ্দীন উমার (রহঃ) সে অঞ্চলের খতীব পদে
অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার বড় ভাই শাইখ আবদুল ওয়াহাব (রহঃ) ছিলেন সে যুগের খ্যাতনামা
আলেম, হাদীস বেত্তা ও
তাফসীরবিদ। এমনকি যয়নুদ্দীন ও বদরুদ্দীন নামক তাঁর পুত্রদ্বয়ও ছিলেন সেকালের
বিরাট খ্যাতিসম্পন্ন হাদীস বেত্তা।
--
১. এই ‘যারা’ নামের আরবী অক্ষর বা
বানানে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। হাফিয আবুল মাহাসিন তাঁর ‘ذيل’ বা পাদটীকায় ذال দিয়ে এবং আল্লামা ইবনুল ইমাদ তার শাযারাস্য যাহাব’ গ্রন্থে زاء দিয়ে লিখেছেন।
২. আলোচ্য শব্দটি নিয়েও
কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী তাঁর ‘দুরারে কামিনাহ’ গ্রন্থে এবং আল্লামা
জালালুদ্দীন সুয়ুতী তাঁর ‘যাইলে তাবাকাতিল হুফফায’ গ্রন্থে ‘আল কাইসী’ লিখেছেন। কিন্তু হাফিয
তাকী উদ্দিন ইবনু ফাহদ তাঁর ‘লাহাযুল আলহায’ গ্রন্থে, নওয়াব সিদ্দীক হাসান
ভূপালী তার ‘আবজাদুল উলুম' গ্রন্থে এবং মুহাম্মদ
ইবনু আবদুর রহমান হামযাহ তাঁর ‘মুকাদ্দামা’য় ‘আলকারশী’ উল্লেখ করেছেন। এই শেষোক্ত শব্দটিই শুদ্ধ ও অভ্রান্ত বলে মনে হয়। কারণ ‘যয়নুদ্দীন আবদুর রহমান ও বদরুদ্দীন আবুল বাকা’ মুহাম্মদ নামক ইবনু কাসীরের (রহঃ) দুই পুত্ররত্নের নামের
সঙ্গেও এই ‘কারশী' শব্দটি অবিচ্ছেদ্যভাবে
সংযুক্ত রয়েছে। সুতরাং পিতা ও পুত্রের ‘নিসবাত’ যে একই ধরনের হবে এতে আর এমন কী সন্দেহ থাকতে পারে?
--
❏ জন্ম ও শিক্ষা-দীক্ষাঃ
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ)
সিরীয়া প্রদেশের প্রসিদ্ধ শহর বসরার অন্তর্গত মাজদল নামক মহল্লায় ৭০০ হিজরীতে
জন্মগ্রহণ করেন। তার ইন্তেকালের সন-তারিখ সম্বন্ধে কোন মতানৈক্য নেই বটে; কিন্তু তাঁর জন্মের
তারিখ-সন নিয়ে তাঁর জীবনীকারদের মাঝে বেশ একটা মতদ্বৈততা লক্ষ্য করা যায়। আল্লামা
হাফিয জালালুদ্দীন সুয়ূতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ-১৫০৫ খ্রীঃ) তাঁর ‘যায়লু তাযকিরাতিল হুফফায' গ্রন্থে, আল্লামা ইবনুল ইমাম
হাম্বালী (মৃঃ ১০৮৯ হিঃ-১৬৭৮ খ্রীঃ) স্বীয় ‘শাযারাতুয যাহাব’ গ্রন্থে১ ইমাম ইবনু কাসীরের জন্ম
সন ৭০০ হিজরী বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাফিয আবু মাহাসিন হুসাইনী দিমাশকী (মৃঃ
৭৬৫ হিঃ -১৩৬৩ খ্রীঃ) তাঁর ‘যাইলু তাযকিরাতিল হুফফায’ গ্রন্থে২, আল্লামা কাযী শাওকানী
(মৃঃ ১২৫০ হিঃ-১৮৩৪ খ্রীঃ) ‘আল বাদরুত তালি’ গ্রন্থে৩, হাফিয শাইখ শামসুদ্দীন
যাহাবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ-১৩৪৭ খ্রীঃ) স্বীয় ‘তাযকিরাতুল হুফফাফ’৪ গ্রন্থের উপক্রমণিকায়, নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান
ভূপালী (মৃঃ ১৩০৭ হিঃ-১৮৮৯ খ্রীঃ) তাঁর ‘আবজাদুল উলুম'৫ গ্রন্থে ৭০১ হিজরী কিংবা
তদুর্ধে বলে লিপিবদ্ধ করেছেন।৬ যাই হোক, ইবনু কাসীরের জন্মের
সময়ে তাঁর পিতা সেই অঞ্চলের খতীবে আযম পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, একথা আগেই উল্লেখ করেছি।
তিন কিংবা চার বছর বয়সের সময়ে শিশু ইবনু কাসীরের স্নেহময় পিতা শিহাবুদ্দীন উমার
৭০৩ হিঃ মুতাবিক ১৩০৩ খ্রীষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন। তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ সহোদর শাইখ
আবদুল ওয়াহাব তাঁর প্রতিপালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শৈশবে পিতৃ বিয়োগের তিন
বছর পর ৭০৬ হিজরীতে ভাইয়ের সংগে তিনি তৎকালীন ধন-ঐশ্বর্যের স্বপ্নপুরী বাগদাদ
নগরীতে উপণীত হন। এই নগরী তখন শিক্ষা-সভ্যতা, জ্ঞান-গরিমা, সংস্কৃতি-কৃষ্টির মর্মকেন্দ্র হিসেবে সারা বিশ্ব জাহানে
শীর্ষস্থানীয়। এই কেন্দ্রবিন্দুতে হাযির হয়ে এখানেই বালক ইবনু কাসীরের জীবনের
যাত্রাপথ শুরু হয়। তিনি জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে ফিকাহ
শাস্ত্রের অধ্যয়ন শুরু করেন। অতঃপর শাইখ বুরহানুদ্দীন ইব্রাহীম বিন আবদুর রহমান
--
১. গ্রন্থটি মিসর থেকে
১৩৫১ হিঃ মুদ্রিত। এর পুরো নাম শারাতুয যাহাব ফী আখবারি মান যাহাব।
২. এটি সমসাময়িককালে
দিমাশক থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
৩. এটি মিসর থেকে ১৩৪৮
হিঃ-১৯২৯ খ্রীঃ মুদ্রিত। এর পুরো নাম ‘আল বাদরুত তালি বিমাহাসিনে মান বা'দাল কারসিন সাবি'।
৪. এটি দায়িরাতুল মা'আরিফ, হায়দরাবাদ, ডেকান থেকে মুদ্রিত।
৫. এটি ভূপালের সিদ্দীকী
প্রেস থেকে ১২৯৫ হিজরী মুতাবিক ১৮৭৮ খ্রীস্টাব্দে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
৬. হাফিয ইবনু হাজার আল
আসকলানী স্বীয় দুরারুল কামিনাহ্' গ্রন্থে ৭০০ হিজরী কিম্বা তার কিছু পরের সময় বলে
বর্ণনা করেছেন।
--
ফাযারী (মৃঃ ৭২৯ হিঃ-১৩২৮
খ্রীঃ)১ এবং শাইখ কামালুদ্দীন ইবনু কাযী শহবার কাছে ফিকাহ
শাস্ত্রের পাঠ সমাপ্ত করেন।২ তখনকার দিনে একটা
চিরাচরিত নিয়ম ছিল যে, কোন শিক্ষার্থী এক
নির্দিষ্ট শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি ও পারদর্শিতা অর্জন করতে চাইলে তাকে সেই শাস্ত্রের
কোন এক খানি সংক্ষিপ্ত পুস্তক বাধ্যতামূলকভাবে কণ্ঠস্থ করতে হতো। এ কারণে তিনি শাইখ আবু
ইসহাক শীরাযী (মঃ ৪৭৬ হিঃ-১০৮৩ খ্রীঃ) কৃত ‘আততামবীহ ফী ফুরুইস
শাফীইয়াহ' নামক গ্রন্থটি আদ্যোপান্ত
কণ্ঠস্থ করে ৭১৮ হিজরীতে তা শুনিয়ে দেন। উসূলুল ফিকহের গ্রন্থাবলীর মধ্যে তিনি
আল্লামা ইবনু হাজিব মালেকী(মৃঃ ৬৪৬ হিঃ-১২৪৮ খ্রীঃ) কৃত ‘মুখতাসার' নামক পুস্তকটি মুখস্থ
করেন। এই মুখতাসার গ্রন্থের ‘শারাহ' বা ভাষ্য লিখেন আল্লামা
শামসুদ্দীন মাহমুদ ইবনু আবদুর রহমান ইসপাহানী (মৃঃ ৭৪৯হিঃ -১৩৪৮ খ্রীঃ)। তাঁর কাছে
গিয়েও বালক ইবনু কাসীর (রহঃ) উসূলুল ফিকহের (Principles of Jurisprudence) গ্রন্থমালা অনন্য মনে
অধ্যয়ন করেন।৩ অনুরূপভাবে হাদীস
শাস্ত্র অধ্যয়নকালে তিনি সমকালীন মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে অনন্য মনে হাদীস শ্রবণ
করেন। আল্লামা হাফিয জালালুদ্দীন সুয়ূতী স্বীয় যায়লু তাযকিরাতিল হুফফায’ গ্রন্থে বলেন سمع الحجار
والطبقة- অর্থাৎ ‘হাজ্জার’ এবং তাঁর সমশ্রেণীর মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে তিনি (ইবনু কাসীর) হাদীস শ্রবণ
করেন।
মুহাদ্দিস হাজ্জার৪ ছাড়া তাঁর সমসাময়িক
যেসব মুহাদ্দিসের কাছ থেকে ইমাম ইবনু কাসীর একাগ্রচিত্তে হাদীস শাস্ত্র অধ্যয়ন
করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে নিম্নোক্ত
মনীষীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যঃ
--
১. ইনি ‘তামবীহ’ গ্রন্থে ভাষ্যকার এবং
জনসাধারণ্যে ‘ইবনু ফারাহু' নামে প্রসিদ্ধ।
২. নওয়াৰ সিদ্দীক হাসান
খাঃ ‘আবজাদুল উলুম’ ৩য় খণ্ড (সিদ্দীকী প্রেস
ভূপাল, ১২৯৫ হিঃ-১৮৭৮ খ্রীঃ) পৃঃ ৭৮০।
৩. আল্লামা হাজী খলীফাঃ ‘কাশফুয যুনুন’।
৪. হাজ্জার ছিলেন সে
যুগের খ্যাতনামা মুহাদ্দিস। সমসাময়িক বিশ্ব মুসলিম জাহানে তার শিক্ষাগারের জুড়ি
মেলা ভার ছিল। দূর দূরান্ত ও দেশ দেশান্তর থেকে তার পাঠাগারে অসংখ্য অগণিত শিক্ষার্থী এসে
অনবরত ভিড় জমিয়ে রাখতো এবং হাদীসের সনদ গ্রহণ
পূর্বক স্বীয় জ্ঞান-পিপাসা চরিতার্থ করে আবার তারা নিজ নিজ দেশাভিমুখে ফিরে যেতো। সর্বসাধারণ্যে তিনি ‘ইবনু শাহনা’ ও ‘হাজ্জার' নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর গুণবাচক উপাধি ছিল ‘মুসনিদুদ দুনিয়া' বা ‘বিশ্ব জাহানের সনদ বর্ণনাকারী ব্যক্তি’ এবং ‘রুহলাতুল আফাক' অর্থাৎ ‘শিক্ষার উদ্দেশ্যে যার দিকে মানুষ দিক-দিগন্ত থেকে যাত্রা শুরু করে।’ তার আসল নাম ছিল আহমাদ, কুনিয়াত বা উপনাম ছিল আবুল আব্বাস, আর লকব ছিল শিহাবুদ্দীন।
তাহলে কুলজী বা নসবনামা ছিল নিম্নরূপঃ আহমদ বিন আবি তালিব বিন আবি নয়াম নু’মা বিন হাসান বিন আলী বিন বায়ান মুকরিনী আসসালিহী। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী
তার ‘আদ্-দুরারুল-কামিনাহ’ গ্রন্থে এবং হাফিয
শামসুদ্দীন ইবনু তুলুন الغرف العلية قى ذيل الخواهر المضية গ্রন্থে হাজ্জার সম্পর্কে
ব্যাপক ও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তার শিক্ষকমণ্ডলীর ফিরিস্তি যেমন দীর্ঘ, তেমনি তার হাদীস বর্ণনার
সূচীও বেশ লম্বা। হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ তিনি এত দীর্ঘ বয়স প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, দাদা এবং পৌত্রদেরকে
স্বীয় ছাত্র হিসেবে এবং সঙ্গে পড়াবার তিনি সুযোগ লাভ করেছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ
দিমাশক নগরী এবং অন্যান্য স্থানে শুধুমাত্র সহীহ বুখারীই তিনি ৭০ (সত্তর) বারের
বেশী পড়িয়েছিলেন। হাদীসের হাফিযগণ তার কাছ থেকে নির্বাচিত হাদীসগুলোর সবক নিতেন
এবং দূর-দূরান্তর ও দেশ-দেশান্তর থেকে হাদীস শিক্ষার্থে তাঁর কাছে ছুটে আসতেন এবং
তাদের হাদীস সংক্রান্ত জ্ঞান-পিপাসা নিবারণ করতেন। অবধারিত মৃত্যুর মাত্র এক
দিন আগে মুহিব উদ্দিন ইবনুল মুহিব তাঁর কাছে বুখারী শরীফ শুরু করেন। পরের দিন
যুহরের নামায পর্যন্ত বুখারী
শরীফের সবক দান চলছিল, এমন সময় আকস্মিকভাবে
যুহরের নামাযের অব্যবহিতপূর্বে ৭৩০ হিজরীর ২৫শে সফরে এ প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা
হাজ্জার পরলোক গমন করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
--
১) বাহাউদ্দীন বিন কাসিম
বিন মুযাফফর বিন আসাকির (মৃঃ ৭২৩ হিঃ-১৩২৩ খ্রীঃ)।
২) শাইখু যাহিরিয়া
আফীফুদ্দীন ইসহাক বিন ইয়াহিয়া আল আমিদী (মৃঃ ৭২৫-১৩২৪খ্রীঃ)।
৩) ঈসা ইবনুল মুতইম।
৪) মুহাম্মদ বিন যরাদ।
৫) বদরুদ্দীন মুহাম্মদ
ইবনু ইবরাহীম ইবনু সুয়াইদী (মৃঃ ৭১১ হিঃ-১৩১১ খ্রীঃ) ৬) ইবনুর রাযী।
৭) হাফিয জামালুদ্দিন
ইউসুফ আল মযী শাফিঈ (মৃঃ৭৪২ হিঃ১৩৪১ খ্রীঃ)।১
৮) শাইখুল ইসলাম তাকিউদ্দিন
আহমদ ইবনু তাইমীয়া ‘আল হাররানী (মৃঃ ৭২৮ হিঃ - ১৩২৭ খ্রীঃ)।২
৯) আল্লামা হাফিয
শামসুদ্দীন যাহবী (মৃঃ৭৪৮ হিঃ - ১৩২৭ খ্রীঃ)।৩
১০) আল্লামা ইমাদুদ্দীন
মুহাম্মদ ইবনু আস-শীরাযী (মৃঃ ৭৪৯ হিঃ১৩৪৮ খ্রীঃ)।
হাফিয ইবনু কাসীর (রঃ) উপরোক্ত মুহাদ্দিসদের মধ্যে যাঁর কাছ
থেকে সব চেয়ে বেশী শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ লাভ করে উপকৃত হয়েছিলেন তন্মধ্যে ‘তাহযীবুল কামাল’ প্রণেতা সিরীয়া দেশীয় মুহাদ্দিস আল্লামা হাফিয জামালুদ্দিন ইউসুফ ইবনু
আবদুর রহমান মযী শাফিঈ (মৃঃ ৭৪২ হিঃ-১৩৪১ খ্রীঃ) বিশেষভাবে উল্লেখের দাবীদার।
অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁর প্রিয়তমা কন্যার সঙ্গে
--
১. এঁর রচিত ‘তাহযীবুল কামাল’ নামক অনবদ্য গ্রন্থটি
হায়দরাবাদ ডেকানের ‘দায়িরাতুল মা'আরিফ' প্রেস থেকে মুদ্রিত ও
প্রকাশিত। এর সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে।
২. এর জীবন কথা ও
সাহিত্য-কর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতির জন্য দ্রঃ শিহাবুদ্দীন ফজল উমরীকৃত ‘মাসালিকুল আবসার', ইবনু রজব হাম্বালী কৃত ‘তাবাকাত’, ইবনু শাকির কৃত ‘ফওয়াতুল অফিয়াত’, শাইখ মারঈ কৃত, ‘কাওয়াকিবুদ দুররিয়াহ্’, নওয়াব সিদ্দীক হাসান খাঁ ভূপালী কৃত ‘আতাজুল মুকাল্লাল’ (সিদ্দীকী প্রেস ভূপাল, ১২৯৯ হিঃ) পৃঃ ২৮৮।
৩. এর ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ নামক অমর গ্রন্থটি
হায়দারাবাদ ডেকানের, দায়িরাতুল মা'আরিফ' থেকে মুদ্রিত।
--
হাফিয ইবনু কাসীর (রহঃ)
শুভ পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এই শুভ বন্ধনের অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি হিসেবে এই
ওস্তাদ-শাগরিদের পবিত্র সম্বন্ধ আরও ঘনিষ্ঠ-নিবিড় এবং সুদৃঢ় হয়।১ সুতরাং এই শ্রদ্ধাস্পদ
মহান শিক্ষকের অন্তহীন স্নেহ মমতার ছত্রছায়ায় বহুদিন পর্যন্ত অবস্থান করে তিনি
পূর্ণমাত্রায় উপকৃত হয়েছিলেন এবং এই সূবর্ণ সুযোগের তিনি সদ্ব্যবহার করেছিলেন।
বেশ কিছুকাল ধরে তিনি এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক তথা স্নেহময় শ্বশুরের সাহচর্য ও
সান্নিধ্য লাভ করে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান ‘তাহযীবুল কামাল’ ও অন্যান্য গ্রন্থাবলী
তার কাছ থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে শ্রবণ করেন। এভাবেই তিনি পবিত্র হাদীসের পঠন পাঠন ও
অধ্যয়নে সম্পূর্ণতা অর্জন করতে সমর্থ হন।এ প্রসঙ্গে আল্লামা হাফিয জালালুদ্দীন
সুয়ূতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ-১৫০৫ খ্রঃ) বলেনঃ تخرخ بالمزى و لازمه وبرعঅর্থাৎ ‘হাফিয জামালুদ্দীন মীর
সান্নিধ্যে দীর্ঘদিন অবস্থান করে তিনি বিপুল ব্যুৎপত্তি ও পারদর্শিতা অর্জন করেন।’২
অনুরূপভাবে শাইখুল ইসলাম
হাফিয ইবনু তাইমীয়ার (মৃঃ ৭২৮ হিঃ-১৩২৭ খ্রীঃ) সান্নিধ্যে অবস্থান করে তাঁর কাছ থেকেও
তিনি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (মৃঃ ৮৫২
হিঃ-১৪৪৮ খ্রীঃ) বলেনঃ মিসর থেকে ইমাম আবুল ফাতাহ দাবুসী, ইমাম আলী ওয়ানী৩ এবং ইউসুফ খুতনী৪ প্রমুখ সমসাময়িক
মুহাদ্দিসরা তাঁকে হাদীস অধ্যাপনার স্পষ্ট অনুমতি দান করেন। এভাবে মহামতি ইমাম
ইবনু কাসীর মুসলিম জগতের বিভিন্ন শিক্ষায়তনে বিভিন্ন উস্তাদের কাছ থেকে হাদীস, তাফসীর ও তারিখের প্রায়
সকল শাখায় এমন অনুসন্ধিৎসা ও নিষ্ঠার সঙ্গে জ্ঞানার্জন করেন যে, সারা
--
১. ‘আল-বাঈসুল হাসীস' শারহু ইখতিসারি উলুমিল
হাদীসঃ সম্পাদনাঃ আহমদ শাকিরঃ মুকাদ্দিমাঃ আবদুর রহমান হামযাহ(দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বাইরুত)পৃঃ ১।
২. ‘যায়লু তাবাকাতিল হুফফায’ (দিমাশক প্রেস) পৃঃ ১৯৪।
৩. সম্ভবতঃ এঁর পুরো নাম
হাফেজ আমিনুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনু ইবরাহীম ওয়ানী (মৃঃ ৭৩৫ হিঃ১৩৩৪ খ্রীঃ)। আল্লামা
হাফিয জালালুদ্দীন সুয়ূতী স্বীয় ‘যায়লু তাযকিরাতিল হুফফায’ গ্রন্থে এঁর জীবন কথা সম্পর্কে আলোকপাত করেন এবং তাঁকে
হাদীসের হাফিয রূপে আখ্যায়িত করেন। আল্লামা হাফিয আবদুল কাদের কারশী (মৃঃ ৭৭৫
হিঃ-১৩৭৩ খ্রীঃ) তাঁর কাছে হাদীস শরীফের সবক গ্রহণ করেন এবং স্বীয় ‘জওয়াহিরুল মজিয়াহ ফী তাবাকাতিল হানাফিয়া’ গ্রন্থে অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নামোল্লেখ করেন। শুধু তাই
নয়, তিনি তাঁকে الامام
المحدث নামক অনুপম উপাধিতে ভূষিত করেন।
৪. ইনি মিসরের তদানীন্তন
প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা বদরুদ্দীন ইউসুফ ইবনু উমার খুতনী। স্বীয় কৃতিত্বের স্বাক্ষর
হিসেবে তিনি ‘মুসনাদুল বিলাদিল
মিসরিয়াহ’ উপাধিতে ভূষিত হন। ‘আলী ইসনাদে’ (যে হাদীসের সনদ বা
বর্ণনা সূত্রে মাধ্যম অতি অল্প) সত্যিই তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। তিনি ৭৩১ হিঃ
মুতাবিক ১৩৩০ খ্রীঃ ৮৪ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী, আহমদ দিইয়াতী এবং হাফিয
আবদুল কাদির কারশীর তিনি শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন। এই শেষোক্ত মুহাদ্দিস অর্থাৎ
হাফিয কারশী স্বীয় ‘জওয়াহিরুল মজিয়াহ’ গ্রন্থে অতি নিষ্ঠা ও
শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নামোল্লেখ করেন।
--
মুসলিম জাহানের আহলে
সুন্নাহ এবং অন্যান্যদের কাছেও অপ্রতিদ্বন্ধী ইমাম হওয়ার গৌরবময় আসন অলংকৃত করতে
সক্ষম হন। তার অপরিতৃপ্ত ও অনন্য সাধারণ শাস্ত্র-জ্ঞান-পিপাসা, অসাধারণ ধীশক্তি, অপরিসীম বিদ্যাবত্তা ও
সর্বতোমুখী প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে শৈশব এবং কৈশোর থেকেই। হাদীস ও তাফসীর ছাড়া ফিকাহ, অসূলে ফিকাহ, আরবী ভাষা ও সাহিত্য, তারীখে ইসলাম প্রভৃতিতেও
তিনি সমান দক্ষতা ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আল্লামা হাফিয ইবনুল
ইমাদ হাম্বালী (মৃঃ ১০৮৯ হিঃ-১৬৭৪ খ্রী) ইবনু হাবীব থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনঃ
انتهت إليه رياسة العلم في
التاريخ و الحديث و التفسر
‘ইসলামের ইতিহাস, হাদীস ও তাফসীর বিষয়ক
জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশাল রাজত্ব তাঁর কাছে গিয়েই শেষ সীমান্তে উপনীত হয়েছে।১
প্রথিতযশা ঐতিহাসিক আল্লামা আবুল মাহাসিন জামালুদ্দীন
ইউসুফ বিন সাইফুদ্দীন বিন তাগরীবিরদী (মৃঃ ৮৭৪ হিঃ -১৪৬৯ খ্রঃ) المنهل
الصافى المستوفى بعد الوا নামক গ্রন্থে বলেনঃ
وكان له اطلاع عظيم في
الحديث و التفسير و الفقه و العربية
অর্থাৎ হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ এবং আরবী ভাষা ও
সাহিত্যে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল।২ অনুরূপভাবে হাফিয আবুল
মাহাসিন হুসাইনি দিমাশকী (মৃঃ ৭৬৫ হিঃ-১৩৬৩ খ্রীঃ) তাঁর ‘যাইলু তাযকিরাতুল হুফফায’ নামক গ্রন্থে বলেনঃ
وبرع في الفقه و التفسير و
النحو و أمعن النظر في الرجال و العلل
অর্থাৎ ফিকাহ শাস্ত্র, তাফসীর, সাহিত্য ও ব্যাকরণে তিনি
বিপুল পারদর্শিতা লাভ করেন ও হাদীসের ‘রিজাল’ (রাবী বা বর্ণনাকারীগণ) ও হাদীসের ‘ইলাল’ (রাবীদের বর্ণনা সূত্রের
প্রছন্ন দোষ-ক্রটি নির্ণয়) প্রসঙ্গে তাঁর অন্তদৃষ্টি ছিল সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ম ও গভীর।
হাদীস শাস্ত্রে এই অগাধ জ্ঞান ও সূক্ষ্মদৃষ্টির কারণেই
তিনি পরবর্তীকালে ‘হুফফাযুল হাদীস' নামক উঁচু দরের হাদীস
শাস্ত্রজ্ঞদের পর্যায়ভুক্ত হতে পেরেছিলেন। শায়খ মুহাম্মদ আবদুর রাযযাক হামযাহ
বলেনঃ
--
১. হাফিয ইবনুল ইমাদঃ ‘জওয়াহিরুল মজিয়াহ' ফী তাবাকাতিল হানাফীয়া’ঃ হায়দরাবাদ ডেকান, দায়িরাতুল মা'আরিফ প্রেস, ১৩৩২ হিঃ পৃঃ ১৩৯।
২. আবুল মাহাসিন
জামালুদ্দীন তাগরীবিরদীঃ ‘আল মানহালুস সাফীঃ পূঃ
৩৪৫; হাজী খলীফাঃ ‘কাশফুয যুনুন’ঃ Edited by Gustav Flugel,
Leipzig: (1835) p.42-49; Also see: "Wafayat-al Ayan' by ibn Khallikan No.
28 Gottingen, 1835; হাফিয শামসুদ্দীন যাহবী ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ ২য় খণ্ডঃ Edited by sayid Mustafa
Ali: Hyderabad, India, 1330: "The Encyclopaedia of Islam': Edited by A.G.
Wensink, Vol. 11 Part 1 Sup pl I (Luzac & Co. London, 1934) p.393.
--
ولقد كان للإمام ابن كثير
حياة علمية حافلة بالجهد في التحصيل و التصنيف في عصر مملوء بالاكابر من علماء
النقل والعقل كما ستقف على ذالك (البعث الحثيث)
‘নিঃসন্দেহে ইমাম ইবনু কাসীর সারা জীবন ধরে জ্ঞান চর্চা করেছেনঃ এই জ্ঞানার্জন
ও গ্রন্থ প্রণয়নে তিনি পরিশ্রম কম করেননি। অথচ এমন যুগে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন যখন
হাদীস, তাফসীর ও অন্যান্য
শাস্ত্রের পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের কোনই অভাব ছিল না।১
হাফিয শামসুদ্দীন যাহবী
স্বীয় ‘তাযকিরাতুল হুফফা' নামক অনবদ্য গ্রন্থের
পরিশিষ্টে বিশিষ্ট হাদীস, অধ্যাপকমণ্ডলীর পরিচয়
প্রদানকালে ইমাম ইবনু কাসীরের বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেছেন। অতঃপর হাফিয
জালালুদ্দীন সুয়ূতী (মৃঃ ৯১১, হিঃ-১৫০৫ খ্রীঃ) স্বীয় ‘যাইলু তাযকিরাতুল হুফফায’ গ্রন্থে ইবনু কাসীরের বিস্তৃত জীবন কথা লিপিবদ্ধ করেন এবং
আল্লামা আবুল মাহাসীন হুসাইনীও তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।২
❏ কাব্য চর্চায় ইবনু কাসীর (রহঃ)
ইমাম ইবনু কাসীর কাব্য
রচনায় ছিলেন পারঙ্গম ও সিদ্ধহস্ত। তাঁর স্বরচিত কবিতামালা তার বিভিন্ন
গ্রন্থাবলীর পৃষ্ঠায় বিচ্ছিন্নভাবে পরিদৃষ্ট হয়। নিম্নে আমরা তাঁর কবিতা থেকে
কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করছিঃ
تمر بنا الايام تترى و رانما
* نساق إلى الأجال و العين تنظر
দিনের পর দিন অতীতের
অন্তহীন পথে বিলীন হতে চলেছে, আর আমরা দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদেরকে ক্রমান্বয়ে
মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
فلا عائد ذاك الشباب الذي
مضى* ولا زائل هذا المشيب المكدر"
অতিক্রান্ত জীবন যৌবন কোন
দিনই ফিরে পাবার নয়, আর এই ক্লেদযুক্ত
বার্ধক্যও আদৌ দুরে সরার নয়।৩
শেষের চরণটিতে ذاك
الشباب স্থলে صفو اشباب হলে খুব ভাল হতো।
--
১. শাইখ মুহাম্মদ আবদুর
রাযুক হামযাহঃ “আল-বাইসুল হাদীস' গ্রন্থের উপক্রমণিকাঃ পৃঃ
১৩।
২. হাফিয আবুল মাহাসিন
হুসাইনী দিমাশকীঃ 'যাইলু তাযকিরাতুল হুফফায'ঃ (দিমাশক থেকে
মুদ্রিত)পৃঃ ১৮৪; হাজী খলীফাঃ কাশফুয
যুনূনঃ পৃঃ ২৩৪, মুহাম্মদ শফী এম, এ, ডি, ও, এল, (পাঞ্জাব) সম্পাদিত ‘দায়িরায়ে মা'আরিফে ইসলামিয়াঃ ১ম
খণ্ডঃ পৃঃ ৬৫৪; ডঃ মুহাম্মাদ হুসাইন
আযহবীঃ ‘আতাফসীর ওয়াল মুফাসসিরূন’ ঃ ১ম খণ্ড, ২য় সংস্করণ (১৯৭৬ খ্রীঃ)
পৃঃ ২৪২-৪৩, আল্লামা শাইখ দাউদীঃ 'তাবাকাতুল মুফাসসিরূন’ঃ পৃঃ ৩২৭।
৩. নওয়াব সিদ্দকী হাসান
খা ভূপালীঃ ‘আবজাদুল উলুম’ঃ ৩য় খণ্ড (সিদ্দীক
প্রেস ভূপাল) পৃঃ ৭৮০; ‘তাফসীর ইবনু কাসীর’ উর্দু অনুবাদের শুরুতে
মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানীর ভূমিকাঃ পৃঃ ৪; মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাসুদেবপুরী কৃত ইবনু কাসীর' শীর্ষক প্রবন্ধঃ মাসিক
তরজমানুল হাদীস ১ম সংখ্যাঃ পৃঃ ৩১।
--
❏ ইমাম ইবনু কাসীর ইমাম
ইবনু কাসীরের প্রতি সমসাময়িক মনীষীদের শ্রদ্ধা নিবেদন
একবার হাফিয যাইনুদ্দীন
ইরাকীকে (মৃঃ ৮০৬ হিঃ- ১৪০৩ খ্রীঃ) জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ ইমাম মুগলতাঈ (৭৬২
হিঃ-১৩৬০ খ্রীঃ), ইমাম ইবনু কাসীর, ইবনু রাফে, হাফিয হুসাইনী এই চারজন
সমসাময়িক মনীষীর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? আল্লামা হাফিয যাইনুদ্দীন ইরাকী এই প্রশ্নের উত্তরে বলেনঃ
এঁদের মধ্যে বংশ-পরম্পরায় জ্ঞানে সবচেয়ে বেশী পারদর্শী হলেন আল্লামা মুগলতাঈ, হাদীসের মূল অংশ ও ইতিহাস
সম্পর্কে সবচেয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হচ্ছেন ইমাম ইবনু কাসীর, আর হাদীস শাস্ত্রের
অনুসন্ধান বিশারদ এবং বিভিন্ন প্রকারের হাদীস সম্পর্কে অতি সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন
হচ্ছেন ইবনু রাফে এবং স্বীয় উস্তায, সমসাময়িক মুহাদ্দিস ও হাদীসের বর্ণনা সূত্র সম্পর্কে অধিক
অবহিত হলেন হাফিয হুসাইনী দিমাশকী (মৃঃ ৭৬৫ হিঃ-১৩৬৩ খ্রীঃ)।
হাফিয শামসুদ্দীন যাহবী
(মৃঃ৭৪৮ হিঃ-১৩৪৭ খ্রঃ), তার ‘আল-মুজামুল মুখতাস’ এবং ‘তাযকিরাতুল হুফ্ফায’ নামক অনবদ্য গ্রন্থদ্বয়ে
বলেনঃ
‘ইবনু কাসীর একজন
খ্যাতনামা মুফতী (ফতওয়া প্রদানে বিশেষজ্ঞ), বিজ্ঞ মুহাদ্দিস, আইন অভিজ্ঞ ফিকাহ শাস্ত্রবিদ, বিচক্ষণ তাফসীরকার এবং রিজাল শাস্ত্রে ১বিশেষ পারদর্শী। হাদীসের
মতন (মূল অংশ) সম্পর্কে তাঁর অভিনিবেশ ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি হাদীসের তাখরিজ (অজ্ঞাত, অখ্যাত সনদকে খুঁজে বের
করেছেন, আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন, গ্রন্থরাজি রচনা করেছেন
এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই চরম উৎকর্ষ সাধন করেছেন।২
--
১. অর্থাৎ হাদীস সংগ্রহ
বিজ্ঞান। বিভিন্ন কালে স্বার্থান্ধ ও মিথ্যা ভাষীরা রাসূলের বাণী বলে যেসব স্বরচিত
মতামত প্রচারের প্রয়াস পেয়েছে, মুহাদ্দিসগণ অতি কষ্টে সৃষ্টে সেগুলো সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে
গেছেন। এই মনগড়া হাদীসের প্রাচুর্য দেখে প্রত্যেক হাদীস সংকলয়িতার এটাই প্রধান
প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় যে, যেসব রাবী (বর্ণনাকারী)
আঁ- হযরতের মুখ-নিঃসৃত বাণী সূত্র পরম্পরায় তার কান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁরা কি প্রত্যেকেই
ইতিহাসের কষ্টিপাথরে বিশস্ত ও সন্দেহ বিমুক্ত বলে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন? অনুরূপভাবে তাঁদের মধ্যে
কে বিশ্বাসপরায়ণ, কে অবিশ্বস্ত, কে সন্দেহ বিমুক্ত এবং
সন্দেহযুক্ত এটাও বিচার্য বিষয়। এরূপে হাদীসের সত্যাসত্যতা বিচারকল্পে রাবীগণের
জীবন রচিত সম্বলিত যে একটি বিরাট শাস্ত্র গড়ে উঠে, সেটাই রিজাল শাস্ত্র। বস্তুতঃ এই হাদীস সগ্রহ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণকে যে শ্রম স্বীকার করতে হয়েছে, রাবীগণের জীবন চরিত
সংগ্রহের ব্যাপারে আরও অধিক কষ্ট অকাতরে স্বীকার করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের
বিচার বিশ্লেষণমান ছিল অত্যন্ত কঠোর ও নিখুঁত। এ কারণেই লক্ষ লক্ষ হাদীস
মুহাদ্দিসগণের সংকলন গ্রন্থ থেকে বাদ পড়ে গেছে। এই লক্ষাধিক হাদীসকে যাচাই-বাছাই
করে শুধুমাত্র নির্ভুল ও অকাট্য প্রমাণিত হাদীসগুলোকে সংকলন-গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত
করা বেশ একটা দুরূহ ও দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। রাবী বা বর্ণনাকারীদের সত্যবাদিতা ও
নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে এই যুক্তি ভিত্তিক আলোচনা ‘রিজাল শাস্ত্র' নামে আবহমানকাল বিশ্ব মুসলিমের কাছে অতীত ঐতিহ্যের
পরাকাষ্ঠা হয়ে রয়েছে।
২. হাফিয যাহবীঃ ‘আল মুজামুল মুখতাস’ এবং ‘তাযকিরাতুল হুফফায়' (দারিয়াতুল মা'আরিফ প্রেস, হায়দরাবাদ ডেকান); আল্লামা ইবনুল ইমাদঃ
শাহারাতুয-যাহাব’ঃ ষষ্ঠ খণ্ডঃ পৃঃ ২৩১-২৩৩; আল্লামা দাউদীঃ 'তাবাকাতুল মুফাসসিরীন’ঃ পৃঃ ৩২৭।
--
হাফিয হুসাইনী এবং
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থে ইমাম ইবনু কাসীর সম্পর্কে
মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ “তিনি হাদীসের বিশিষ্ট
অধ্যাপক, হাদীস শাস্ত্রের হাফিয, প্রখ্যাত আলিম এবং ইমাম, বক্তৃতায় সুনিপুণ এবং
বহু গুণ ও উৎকর্ষের অধিকারী।।
আল্লামা শাইখ ইবনুল ইমাদ
হাম্বালী (মৃঃ ১০৮৯ হিঃ- ১৬৭৮ খ্রীঃ) ইমাম ইবনু কাসীর (রঃ) কে ‘আল হাফিযুল কাবীর’ বা ‘মহান হাফিয’ অর্থাৎ কুরআনের শেষ্ঠ
শ্রুতিধর বলে আখ্যায়িত করেন।১
অনুরূপভাবে তাঁর
খ্যাতনামা প্রিয় শিষ্য আল্লামা হাফিয ইবনুল হজ্জি (মৃঃ ৮১৬ হিঃ-১৪১৩ খ্রীঃ)
স্বীয় শ্রদ্ধাষ্পদ উস্তাদ (ইবনু কাসীর) সম্পর্কে অভিমত জানাতে গিয়ে বলেনঃ
احفظ من ادركناه لمتون الأحاديث
وأعرفهم بجرحها و رجالها و سحيحها وسقيمها و كان اقرانه وشيوخه يعترفون له پذلك
وما أعرف انى اجتمعت به على كثرة ترددى الا و استقدت منه -
‘আমরা যেসব হাদীস শাস্ত্রজ্ঞকে পেয়েছি তন্মধ্যে তিনি (ইবনু কাসীর) হাদীসের মতন
বা মূল অংশ সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ শ্রুতিধর এবং দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে, হাদীস রিজাল শাস্ত্র জ্ঞানে
ও বিশুদ্ধ-দুর্বল হাদীস নির্ধারণে ছিলেন সবার চেয়ে অভিজ্ঞ। তাঁর সমসাময়িক উলামা
ও উস্তাদবৃন্দ সবাই তার এই মান মর্যাদার কথা এক বাক্যে স্বীকার করেন। তাঁর কাছে
আমি বহুবার যাতায়াত করেছি, তবু একথা স্বীকার করতে
দ্বিধা নেই যে, যতবারই আমি তাঁর খিদমতে
গিয়ে উপনীত হয়েছি, কোন না কোন বিষয়ে তাঁর
কাছে জ্ঞানলাভে ধন্য ও কৃতার্থ হয়েছি।২ আল্লামা হাফিয ইবনু
নাসিরুদ্দীন আদ্-দিমাশকী (মৃঃ ৮৪২হিঃ-১৪৩৮ খ্রীঃ) তার (ইবনু কাসীরের) প্রসঙ্গে
বলেনঃ
--
১. আবদুল হাই ইবনুল ইমাদঃ ‘শারাতুয যাহাব ফী আখবারে
মান্ যাহাব’ ঃ ষষ্ট খণ্ডঃ পৃষ্ঠা ২৩৮; ইবনু কাসীরঃ ‘ইখতিসারু উলুমিল হাদীস' (মাজেদীয়া প্রেস, মক্কা মুকাররামাঃ ১৩৫৩
হিঃ)-এর শুরুতে মুহাম্মদ বিন আবদুর রাযযাক হামযাহ কৃত ‘হায়াতুল ইমাম ইবনু কাসীর’ শীর্ষক উপক্রমণিকাঃ পূঃ
১৪, ডঃ মুহাম্মদ হুসাইন আহবীঃ
‘আতাফসীর ওয়াল মুফাসসিরূন’ঃ ১ম খণ্ড, ২য় সংস্করণ (দারূল
কুতুবিল হাদীসাহ (১৯৭৬ সাল) পৃঃ ২৪৩; হাফিয ইবনু হাজারঃ ‘আদ্বারুল কামিনা’ঃ ১ম খণ্ডঃ পৃষ্ঠা
৩৭৩-৩৭৪।
২. মাওলানা মুহাম্মদ
হুসাইন বাসুদেবপুরীঃ ‘ইমাম ইবনু কাসীর' শীর্ষক প্রবন্ধঃ মাসিক ‘তরজমানুল হাদীস’ঃ ১১শ বর্ষঃ ১ম সংখ্যাঃ
পৃঃ ৩২; ইমাম ইবনু কাসীর কৃত ‘ইখতিসারু উলুমিল হাদীস’-এর ব্যাখ্যা ‘আল বাইসুল হাসীস’-এর শুরুতে মুহাম্মদ বিন
আবদুর রাযযাক হামযাহকৃত ‘হায়াতুল ইমাম ইবনু কাসীর’ শীর্ষক উপক্রমণিকা (দারুল
কুতুবিল ইলমিয়া, বাইরুত, ১৯৫১) পৃঃ ১৬; আল্লামা কিনানীঃ
আরিসালাতুল মুসতাতরাফা' পৃঃ ১৪৬।
--
আল্লামা হাফিয ইমাদুদ্দীন
ইবনু কাসীর ছিলেন মুহাদ্দিসগণের নির্ভর, ঐতিহাসিকদের অবলম্বন এবং তাফসীর বিদ্যা বিশারদদের উন্নত
ধ্বজা।১ হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (৮৫২ হিঃ)২ তাঁর আদ্দুরারুল কামীনা’ গ্রন্থে বলেনঃ
و اشتفل پالحديث مطالعة في
متونه و رجاله و كان كثير الإستحضار حسن المفاكهة صارت تصانيفه في حياته و انتفع
الناس بها بعد وفاته و لم يكن على طريق المحدثين في تحصيل العوالى و تمييز العالى
من
--
১. আল্লামা ইবনু
নাসীরুদ্দীন দিমাশকীঃ ‘আর-রাদ্দুল
ওয়াফিরঃ পূঃ ২৬৯; ডঃ মুহাম্মদ হুসাইন
আযযাহাবীঃ ‘আত্তাফসীর
ওয়াল মুফাস্সিরূন' ১ম খণ্ডঃ ২য় সংস্করণ (পুর্বোক্ত) পৃঃ ২৪২-৪৩।
২. হাজার তার পিতৃপুরুষের
নাম। ৭৭৩ হিঃ মিসরের মাটিতে তার জন্ম। ৪ বছর বয়সে পিতৃ বিয়োগের পর কুরআন হিফয ও অন্যান্য গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করেন। ১১ বছর বয়সে হজ্জ পালনার্থে
মক্কা শরীফ গিয়ে সেখানে বুখারীসহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থাদি পাঠ করেন। ৮০২ হিজরীতে
গিয়ে কাসেম, হাজ্জার এবং তাকিউদ্দীন
সুলাইমান প্রমুখ প্রখ্যাত মুহাদ্দিসদের কাছে হাদীস অধ্যয়ন করে তা বর্ণনার অনুমতি
লাভ করেন। অতি শৈশব থেকেই তার অনন্য মেধাশক্তির বিকাশ ঘটে। ৮২৭ হিজরী থেকে নিয়ে
দীর্ঘ ২১ বছর পর্যন্ত তিনি কায়রো ও তৎপার্শ্বস্থ দেশসমূহের কাযী পদে নিয়োজিত
থাকেন। এছাড়া জীবনের অধিকাংশ সময় ধর্মীয় বিদ্যা-বিশেষতঃ হাদীস শাস্ত্রের প্রচার, প্রসার, অধ্যাপনা, গ্রন্থ সংকলন ও ফতওয়া
প্রদান কার্যে অতিবাহিত করেন। প্রসিদ্ধ মাহমূদিয়া গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান, জামে’ আযহার প্রভৃতির খতীব এবং
কায়রোর বড় বড় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষা নিকেতনে বহুকাল ধরে তিনি হাদীস, তাফসীর ও ফিকাহ শাস্ত্রের
প্রধান অধ্যাপক পদ অলংকৃত করেন। তার সংকলিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা দেড়শতেরও অধিক।
অধিকাংশ গ্রন্থ হাদীস, রিজাল শাস্ত্র ও ইতিহাস
সম্বন্ধীয় হলেও তন্মধ্যে এমন বহু সংকলন রয়েছে, যাতে আরবী সাহিত্য, ফিকাহ শাস্ত্র, উসূল, কালাম প্রভৃতি নানারকম
বিদ্যার রয়েছে অপূর্ব সমাবেশ। তার
এই দেড় শতাধিক গ্রন্থাবলীর মধ্যে সহীহ বুখারীর ভাষ্য 'ফাতহুল-বার ‘ই
হচ্ছে অনবদ্য অবদান। এই বিশ্ব বিশ্রুত মহাগ্রন্থখানি হাফিয আসকালানী (৮১৭ হিঃ)
লিখতে শুরু করেন। দীর্ঘ ২৫ বছরের একনিষ্ঠ সাধনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তার অমৃত
ফল হিসেবে এই মহামূল্য গ্রন্থটি সমাপ্ত করে তিনি তদানীন্তন মুসলিম জাহানকে উপহার
দিতে সমর্থ হন। এই অবিস্মরণীয় অনবদ্য রচনার পরিসমাপ্তি উপলক্ষে হাফিয ইবনু হাজার
স্বয়ং পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে দেশস্থ আপামর জনসাধারণকে ওলিমার দাওয়াত
দেন। আমন্ত্রিত হাজিরান মজলিসে বড় বড় উলামায়ে কিরামের খিদমতে তিনি এই শ্রেষ্ঠ
কীর্তি পেশ করেন। উপস্থিত রাজা-বাদশাহগণ সুবর্ণ মুদ্রায় ওজন করে তার এই মহামূল্য
গ্রন্থটি খরিদ করেন। কিন্তু এই গ্রন্থ রচনার কিছুকাল পরই স্বনামধন্য গ্রন্থকার উদরাময় রোগে
আক্রান্ত হয়ে আখেরাতের অবিনশ্বরলোকে যাত্রা করেন।
‘হাদিউস সারী’ বা ‘মুকাম্মাতুল ফাতহ' নামক ‘ফাতহুল বারীর একখানি
তথ্যসমৃদ্ধ ও গবেষণাপূর্ণ ভূমিকা তিনি ইতিপূর্বেই রচনা করেছিলেন। (দ্রঃ মৎপ্রণীত
ইমাম বুখারীঃ ইসলামিক ফাউণ্ডেশন ১৯৭৯)।
--
--
انازل و نحو ذالك من فنوبهم
و إغا هو من محدثى الفقهاء واجاب اسيطى عن ذالك فقال العمدة فى علم الحديث على
معرفة صحيح الحديث وسقيمه عاله ه اختلاف طرقه وجرحا و تعديلا و اما العالى والنازل
و نحو زالك : فهو الفضلات لامن اصول المهمة اه-
অর্থাৎ হাদীসের মতন বা
মৌল অংশ এবং রিজাল বা চরিত অভিধান শাস্ত্রের পঠন-পাঠন ও অধ্যয়নে তিনি সব সময়
নিমগ্ন থাকতেন। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর আর তিনি
রসিকতা-প্রিয় ছিলেন। জীবদ্দশায় তাঁর গ্রন্থরাজি চারদিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে
পড়ে।
এ পর্যন্ত হাফিয ইবনু হাজার তাঁর উচ্ছসিত প্রশংসা
করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার তিনি কিছুটা সমালোচকের ভূমিকাও পালন করেছেন। এ করতে
গিয়ে তিনি বলেনঃ
ইবনু কাসীর সনদ বা
বর্ণনাসূত্রে পরস্পরের মধ্যে আলী ও নাযিলের১ মাঝে তেমন কোন পার্থক্য
প্রদর্শন করেন না। অনুরূপভাবে মুহাদ্দিসসুলভ এ ধরনের অন্যান্য শিল্প, শাস্ত্র ও বৈশিষ্ট্যের
প্রতিও তিনি এতটা উৎসাহী ছিলেন না। সুতরাং তাকে ফকীহগণের মুহাদ্দিস বলা যেতে পারে।'
আল্লামা জালালুদ্দীন
সুয়ূতী এ সমালোচনার উত্তর দিয়েছেন নিম্নরূপঃ ‘আমি বলি, হাদীস শাস্ত্রের মুখ্য বস্তু হচ্ছে বিশুদ্ধ ও দুর্বল হাদীস, বর্ণনাসূত্রের সূক্ষ্মতম
দোষ-ত্রুটি, বিভিন্ন রকমের
বর্ণনাসূত্র সম্পর্কে অবগতি এবং রিজাল বা চরিত অভিধান-শাস্ত্র অর্থাৎ রাবীদের ভাল
মন্দ হওয়ার ব্যাপারে সম্যক পরিচিতি ইত্যাদি। এছাড়া সনদের ‘আলী' কিংবা ‘নাযিল’
হওয়া-এগুলো হচ্ছে একটা অতিরিক্ত
ব্যাপার, মুখ্য বস্তু নয়।'
প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা
আল্লামা যাহিদ বিন হাসান২ আল-কাওসারী (মৃঃ ১৩৭১
হিঃ-১৯৫১ খ্রঃ) ছিলেন কায়রোর একজন খ্যাতিমান আলেম ও মুহাদ্দিস এবং উসমানী
শাসনামলের একজন উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারী। তিনিও এ প্রসঙ্গে বলেনঃ
--
১. হাদীসের যে সনদ বা
বর্ণনারসূত্র পরম্পরায় রাবীদের সংখ্যা অল্প হয় তাকে ‘আলী সনদ’ বলা হয়। আর যে সূত্র পরম্পরায় রাবীদের
সংখ্যা বেশী হয় তাকে ‘নাযিল’ বলে। ফকীহগণ মাসয়ালা
নিরূপণ করতে গিয়ে শুধুমাত্র হাদীসের মতন' বা মূল অংশের প্রতিই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে থাকেন। সনদ বা সূত্র
পরম্পরার প্রতি তারা ততটা ভ্রুক্ষেপ করেন না। সনদকে তারা শুধু এতটুকুই মূল্য দিয়ে
থাকেন যেন তার প্রতিটি রাবীই বিশ্বাসভাজন ও গ্রহণযোগ্য হন। পক্ষান্তরে, মুহাদ্দিসগণের কাছে এর
গুরুত্ব অনেক পরিমাণে বেশী। সনদের মধ্য থেকে একটি মাত্র রাবীর সংখ্যা যদি কম করা
সম্ভব হয় তবে এজন্যে দীর্ঘ পথের পরিক্রমা তাঁদের কাছে আরও প্রশংসনীয়।
মুহাদ্দিসগণের জীবনে এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার ভুরি ভুরি নজীর আমরা পেয়ে থাকি। (মৎ
প্রণীত মুহাদ্দিস প্রসঙ্গ’ দ্রষ্টব্য)।
২. মৎ প্রণীত ইমাম মুসলিম
(ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা ১৯৭৯ পৃঃ ৪৮)।
--
‘হাফিয ইবনু কাসীর যদিও
হাদীসের ‘মতন’ মুখস্থ করার ব্যাপারে ছিলেন বেশী অভ্যস্ত, তবুও তার কাছ থেকে এটা কোন দিনই প্রত্যাশা করা যায় না যে, তিনি রাবীদের স্তরসমূহে
ভেদ-নীতির কোন ধার ধারতেন না। অবশ্য তিনি এ কাজটি ভালভাবেই করতেন। রাবী বা
বর্ণনাকারীদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আলী’ ও ‘নাযিল'-এর মাঝে পার্থক্য তিনি
অবশ্যই করতেন। এই ভেদ-নীতি ও পার্থক্যের ব্যাপারটা তো ঐ সব মুহাদ্দিসের কাছেও গোপন
থাকে না যারা ইবনু কাসীর অপেক্ষা অনেক নিম্ন স্তরের। আর বিশেষ করে শাইখ জামাল
ইউসুফ ইবনু যাকী আল মিযী (মৃঃ ৭৪২হিঃ- ১৩১৪ খ্রীঃ)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে যখন বহুদিন
ধরে তিনি তার কাছে অবস্থান করেছিলেন এবং তার ‘তাহযীবুল কামাল' নামক গ্রন্থটি নিষ্ঠা ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্ধনসহ সম্পাদনা
করে প্রকাশ করে ছিলেন।১
ঐতিহাসিকগণও ইমাম ইবনু
কাসীর (রহঃ)-এর সর্বতোমুখী প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি এবং অগাধ জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে ভূয়সী
প্রশংসা করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল ইমাদ (মৃঃ ১০৯৮ হিঃ- ১৬৭৮ খ্রীঃ) বলেনঃ
يشارك في العربية ينظم نظما
وسطا اه كان كثير الإستحضار قليل النسيان جيد الفهم.
তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ও
ধীশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। কোন বস্তুকে একবার মুখস্থ করে নিলে তার বিস্মরণ খুব
কমই হতো। আর তিনি মেধাবীও কম ছিলেন না।২ আরবী সাহিত্যও তিনি
সৃষ্টি করেছেন এবং মধ্যম পর্যায়ের কবিতাও তিনি রচনা করতেন।
❏ শিক্ষা ও ফতওয়া প্রদান, আল্লাহর গুণগান ও রসিকতাঃ
ইমাম ইবনু কাসীর তাঁর
সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছেন গ্রন্থ রচনা, ফতওয়া প্রদান এবং অধ্যাপনার মহান পেশায়। তার শ্রদ্ধেয়
শিক্ষক আল্লামা হাফিয শামসুদ্দীন যাহাবীর ইন্তেকালের (৪৭৮ হিঃ-১৩৪৭ খ্রীঃ) পর তিনি
দিমাশকের সুপ্রসিদ্ধ ‘উম্মু সাহিল’ ও ‘তাকযিয়াহ' নামক শিক্ষায়তনে হাদীস
অধ্যাপনার মহান পদে অভিষিক্ত হন। এ সময়ে তিনি ঘন্টর পর ঘন্টা ধরে আল্লাহর গুণগান
ও যিকর আযকারে মাশগুল থাকতেন।৩ জীবনে তিনি এত ফতওয়া
প্রদান করেছেন যে, সেগুলো পৃথক গ্রন্থকারে
সংকলিত হতে পারে।
--
১. আল্লামা মুহাদ্দিস
যাহিদ আল-কাউসারীঃ ‘যুয়ুল তাযকিরাতিল হুফফাযে’র ‘তালিকাত'।
২. আল্লামা ইবনুল ইমাদ
হাম্বালীঃ ‘শাযারাতুয যাহাব ফী আখবারি
মান যাহাব' (১৩৫১ হিঃ মিসর থেকে মুদ্রিত) পৃঃ ১৯৭।
৩. ইবনু কাসীর উর্দু
তাফসীরঃ ১ম খণ্ডের শুরুতে মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানী কৃত ‘হায়াতু ইবনু কাসীর’(নুর মুহাম্মদ, তিজারাতু কুতুব করাচী, আরামবাগ) পৃঃ ৬; নওয়াব সিদ্দীক হাসান
খানঃ ‘আবজাদুল উলুমঃ ৩য় খণ্ড
(পূর্বোক্ত) পৃষ্ঠা ৭৮০; হাজী খলীফাঃ ‘কাশফুয যুনূন' (পূর্বোক্ত) পৃঃ ২৩৪, মুহাঃ শফী এম, এ, ডি,ও,এল, সম্পাদিতঃ ‘দায়িরায়ে মাআরিফে
ইসলামীয়া’ঃ ১ম খণ্ডঃ পৃঃ ৪৫৪।
--
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনু
হাবিব বলেনঃ اامام ذى التسبع و التهليل তিনি সদা প্রফুল্ল চিত্ত, খোশ মেজাজ ও খোশ আখলাক ব্যক্তি ছিলেন।
কথাবার্তা ও আলাপ আলোচনার সময়ে তিনি সরস ও মূল্যবান উপমা ও দৃষ্টান্ত ইত্যাদি
ব্যবহার করতেন। আল্লামা হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী তার কিছুটা সমালোচনা১ করলেও বারবারই তার
ভূয়সী প্রশংসায় মুখর হয়েছেন এবং তাঁকে ‘হুসনুল মুফাকাহা’ বা ‘উত্তম রসিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হাফিয যাইনুদ্দীন ইরাকী
(মৃঃ ৮০৬ হিঃ-১৪০৩ খ্রীঃ)২ ছিলেন হাদীস শাস্ত্রে
আল্লামা শাইখ আলাউদ্দীন ইবনু তুর্কমানীর৩ বিশিষ্ট শাগরিদ এবং
তাঁরই লালিত পালিত মন্ত্রশিষ্য। তিনি শাইখুল ইসলাম ইমাম তাকীউদ্দীন সুবকীর
শিক্ষাকেন্দ্রে যখন উপস্থিত হন, তখন শাইখুল ইসলাম তাকে সমাদরে সসম্মানে বসিয়ে এবং উপস্থিত
সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে তার বিদ্যাবত্তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তখন ইমাম ইবনু
কাসীর বলেনঃ আমার তো মনে হয় যে, ইবনু আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত রৌদ্রতপ্ত (মাউন
মুশাম্মাস) পানি দ্বারা অজু করার যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, ইনি সেই হাদীসটিই হয়তো
খুঁজে বের করতে পারবেন না।
❏ আল্লামা ইবনু তাইমিয়ার
সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কঃ
ইবনু কাসীরের স্বনাম
খ্যাত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আল্লামা হাফিয ইবনু তাইমিয়ার৫ সঙ্গে তার ঘনিষ্ট নিবিঢ়
সম্বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন ব্যাপারে এই শিষ্যের উপর উস্তাদের
প্রভাববিস্তার করেছিল অতি প্রগাঢ় ভাবে।
--
১. কাশফুযযুনুন’ লেখক মোল্লা কাতিব চালপী, ইবনু হাজার সম্পর্কে
মন্তব্য করেনঃ
كان قلم ابن حجر سنيا في
مثالب الناس و لسانه حسنا و ليته عکس ليبقى الحسن (کشف الظنون و ضمن الجواهر و
الدرر)
২. ইনি তাকরীবুল আসানীদ’ এবং ‘যাইলু জামেউত তাহসীল’ নামক কিতাবদ্বয়ের লেখক। প্রথমোক্ত গ্রন্থটির ৮ খণ্ডে শারাহ
লিখে প্রকাশ করেন তারই পুত্র আবু যুরআ’ ইরাকী। আর শেষোক্তটির
ব্যাখ্যা করেছেন তার অপর পুত্র ওয়ালী উদ্দীন ইরাকী। তিনি ‘যাইনুল মীযান’ নামেও ইমাম যাহাবীর ‘মীযানুল ই'তিদল’ গ্রন্থের দুই খণ্ডে
পরিশিষ্ট লিখেছেন। এছাড়া তিনি আহমদ বিন আইবাক দিময়াতী কৃত রাবীদের জন্ম মৃত্যু
সম্বন্ধীয় কিতাবের আরও একটি পরিশিষ্ট লিখেছেন। ‘আলফিয়া’,
‘তাখরীজে আহাদিসে ইয়াহিয়াউল উলম’, প্রভৃতি গ্রন্থেরও তিনি
লেখক। তার পুরো নাম আবদুর রহীম বিন সুলাইমান শাফিঈ। (নূর মুহাম্মদ আজমীঃ 'হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস’ঃ পৃঃ ১৩৪)।
৩. ইনি ‘আল-জওহারুন নাকী ফীরাদ্দি আলাল বায়হাকী' প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক।
৭৬৩ হিঃ ১৩৬১ খৃঃ মৃত্যু।
৪. ইনি বহু দিন ধরে
মিশরের প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ‘শিফাউস সাকাম' প্রভৃতি বহু গ্রন্থের তিনি লেখক। ৭৫৬ হিঃ-১৩৫৫ খৃঃ মৃত্যু।
৫. এই স্বনাম ধন্য মনীষীর
নাম আহমদ বিন আবদুল হালীম, উপনাম আবুল আব্বাস, তাকীউদ্দীন তার জনপ্রিয়
উপাধি এবং ইবনু তাইমিয়া নামে তিনি সবার কাছে সুপরিচিত।তাইমিয়া ছিল আসলে তাঁর
পিতামহের মায়ের নাম। তিনি অতি শিক্ষিত ও বিদুষী মহিলা ছিলেন।
এঁর নামের সঙ্গে সম্বন্ধ জুড়ে তিনি ইবনে তাইমিয়া নাম ধারণ করেন। যয়নাব নামেও
আরও একজন উচ্চ শিক্ষিতা বিদুষী মহিলার কাছে তিনি শিক্ষা লাভ করেন। ১২৬৩ খ্রীঃ
দিমাশকের নিকট হারান নামক স্থানে তার জন্ম। তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন অনন্য প্রতিভা ও
স্মৃতিশক্তির অধিকারী। অল্প বয়সেই তাফসীর, হাদীস, আদব, দর্শন ফিকাহ প্রভৃতি
বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রভূত জ্ঞানার্জন করেন। শৈশব ও কৈশোর থেকেই তাঁর শিক্ষকমণ্ডলী
এই অসাধারণ প্রতিভা ও মেধাশক্তি দেখে বিমুগ্ধ হতেন। বিজ্ঞ পিতার ইন্তিকালের পর তার
পরিত্যক্ত শিক্ষায়তনে উত্তরাধিকার সূত্রে অধ্যাপনার দায়িত্বভার অর্পিত হয় সুযোগ্য
সন্তান ইবনে তাইমিয়ার উপর। তিনি অতি নিষ্ঠার সঙ্গে এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন।
তবে তিনি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি পদ অলংকৃত করার প্রস্তাবকে
প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি শুধু সাধারণ বিদ্যাবত্তা এবং সকল শাস্ত্রে অগাধ
পাণ্ডিত্যের অধিকারীই ছিলেন না বরং মসির সঙ্গে অসি চালনার ক্ষেত্রেও তিনি সুদক্ষ
সৈনিক ছিলেন। এভাবে শান্তি ও যুদ্ধ উভয় অবস্থাতেই তিনি জাতির মূল্যবান খিদমত
আঞ্জাম দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদানে জাতি তাঁর প্রতি চালিয়েছে অত্যাচারের ষ্টীম রোলার।
তিনি একাধিকবার কারারুদ্ধ হন। এমন কি বন্দীশালায় তার দুই ভ্রাতা ও প্রিয় শিষ্য
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম বহুদিন পর্যন্ত বন্দী জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। বন্দী যুগে
তাইমিয়া কুরআন মজীদের বিশিষ্ট আয়াতসমূহের তাফসীর লিখতে এবং অন্যান্য গ্রন্থাবলী
প্রনয়ণ ও সংকলন করতে ব্যাপৃত ছিলেন। কিন্তু এতেও নিষেধাজ্ঞা হলে তিনি কয়লা
দ্বারা লেখা সমাপ্ত করেন। এভাবে তার প্রায় ত্রিশাধিক গ্রন্থাবলী মুদ্রিত ও
প্রকাশিত হয়। জনৈক ইয়াহুদীর প্রশ্নোত্তরে উপস্থিত ক্ষেত্রেই তিনি ১৮৪টি কবিতা
লিখে সমাপ্ত করেন। এভাবে প্রতিটি গ্রন্থই তিনি রচনা করেন সম্মুখে কোন সহায়ক
গ্রন্থ না রেখে । তাঁর রচিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পাঁচশো খানা।
--
ইবনু কাসীর অধিকাংশ
মাসয়ালায় হাফিয ইবনু তাইমিয়ার অনুসারী ছিলেন। ইবনু কাযী শাহাবা স্বীয় ‘তাবাকাত’ গ্রন্থে বলেনঃ
كانت له خصوصية بابن تيمية
ومناضلة واتباع له فى كثير من ارائه و كان
يفتی برابه فی مسئلة الطلاق و امتحن بسبب ذالك وأوزى.
আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমিয়ার
সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি ইবনে তাইমিয়ার মত ও পথকে পূর্ণ সমর্থন যুগিয়ে বিতর্ক
করতেন এবং তাঁর বহু মতের অনুসরণ করতেন। তিন তালাকের মাসয়ালাতেও তিনি ইবনে তাইমিয়ার মতানুযায়ী ফতওয়া দিতেন।১ এ কারণে তাঁকে এক ভীষণ
অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং অন্তহীন নির্যাতন যাতনা ভোগ করতে হয়।
--
১. ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে একই মজলিসে তিন তালাক দেওয়া
হলে তা একই তালাক রেজয়ী হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। এটাই ছিল তার অপরাধের মূল কারণ।
এই কারণে সমসাময়িক কুপমণ্ডক আলেমগণ ফতওয়া কার্য থেকে বিরত থাকার জন্যে তার প্রতি
রাজ নিষেধাজ্ঞা জারী করায়। এই অন্যায় ও অবৈধ আদেশকে ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ
ও সত্য গোপন মহাপাপ মনে করে এই আদেশ প্রতিপালন করতে তিনি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
ফলে রাজাদেশ অমান্য করার অপরাধে তাকে পুনরায় বন্দী করা হয়।
--
অবধারিত মৃত্যুর আগে এই
নশ্বর জীবনের শেষভাগে হাফিয ইবনু কাসীর দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন। অতঃপর ১৩৭২
খ্রীষ্টাদ্ধ মুতাবিক ৭৭৪ হিজরীর ২৬শে শাবান রোজ বৃহস্পতিবার এই মহামনীষী অস্থায়ী
দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় নিয়ে আখেরাতের সেই অনন্তলোকে যাত্রা করেন। ইন্না
লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। দিমাশকের সুপ্রসিদ্ধ কবর স্থান ‘সুফীয়া’তে স্বীয় শ্রদ্ধেয়
শিক্ষক ইমাম তাকীউদ্দীন ইবনে তাইমিয়ার কবরের পার্শ্বে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
তাঁর মহা প্রয়াণে তাঁর ভক্ত-অনুরক্ত শিষ্য শাগরিদরা বেদনাবিধুর প্রাণে যে হৃদয়
বিদারক ‘মর্সিয়া বা শোক গাথা
আবৃত্তি করেন, তন্মধ্যে নিম্নের পংক্তি
দুটি উদ্ধৃত করা যাচ্ছেঃ
النقدك طلاب العلم تاسفوا* و
جاروا بدمع لا يبيد غزير*
ولو مزجوا ماء ادمع بالدماء* لكان قليلا فيك يا
ابن کثیر
‘চিরদিনের মতো তোমাকে
হারিয়ে তোমার প্রিয় শিক্ষার্থীগণ আজ হা-হুতাশ করে ফিরছে, আর এ অজস্র ও অকৃপণ
ধারায় অশ্রু বিসর্জন করছে যে, কোন ক্রমেই তা রুদ্ধ হবার নয়। যদি তারা সেই অশ্রুধারার
সঙ্গে তাজা শোনিত সংমিশ্রিত করে দিত, তবুও ‘হে ইবনু কাসীর, এটা তোমার ব্যাপারে যৎসামান্য বলেই গণ্য হতো'।
হাফীয ইবনু কাসীরের
উত্তরাধিকারীদের মধ্যে দুই পুত্ররত্ন ইসলাম জগতে বিপুল খ্যাতি অর্জন করতে সমর্থ
হয়েছেন। এঁদের একজন হচ্ছেন যাইনুদ্দীন আবদুর রহমান আল-কারশী। (মৃঃ৭২৯হিঃ - ১৩২৮
খ্রীঃ) এবং অপরজন বদরুদ্দীন আবুল বাকা মুহাম্মদ আল-কারশী।১
❏ ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) রচিত গ্রন্থমালাঃ
আল্লামা হাফিয ইবনু কাসীর
তার অমর স্মৃতির নিদর্শন হিসেবে এই মরজগতের বুকে যেসব মহামূল্য ধন-সম্পদ ও বিষয়
বৈভব ছেড়ে গেছেন, তন্মধ্যে তাঁর লিখিত
তাফসীরুল কুরআন, হাদীসে রাসূল (সঃ), সীরাতুন্নবী (সঃ), ইতিহাস, ফিকাহ শাস্ত্র ইত্যাদি
সম্বন্ধীয় গ্রন্থাবলী আজও বেশ জনপ্রিয়, সবার কাছে বিশেষ সমাদৃত ও দলমত নির্বিশেষে গ্রহণীয়। প্রায়
সকল যুগের ঐতিহাসিকবৃন্দ ও তাফসীরকারগণ তার ইতিহাস ও তাফসীর সম্বন্ধীয় এবং
অন্যান্য গ্রন্থাবলীর প্রভূত প্রশংসা করেন। স্বনামধন্য মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক
আল্লামা হাফিয শামসুদ্দীন যাহাবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ-১৩৪৭ খ্রীঃ) বলেনঃ ‘লাহু
--
১. ফিলিস্তিনের অন্তর্গত ‘রামলা’ নামক স্থানে এঁর মৃত্যু
হয় (৮০৩ হিঃ-১৪০০ খ্রীঃ)। এঁরা দুই ভাই অর্থাৎ যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তানদ্বয় পিতার মতোই ‘কারশী’ হিসেবে ‘মানসুব’ হয়ে সে যুগের খ্যাতিমান হাদীসবেত্তা
ও তাফসীরকাররূপে সুনাম অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দ্রঃ মৎ প্রণীত ইমাম নাসাঈঃ
(ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, ঢাকা, ১৯৭৯) পৃঃ ৩৭,৩৮।
--
তাসানীফু মুফীদাহ’ অর্থাৎ তাঁর রচিত
গ্রন্থমালা বেশ উপকারী।১ আল্লামা হাফিয ইবনু
হাজার আসকালানীর মতে ‘তাঁর (ইবনু কাসীরের) জীবদ্দশাতেই তাঁর মহামূল্য গ্রন্থাবলী বিভিন্ন
নগর বন্দরে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে এবং তার মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে প্রায়
সকল লোকই তদ্বারা বেশ লাভবান ও উপকৃত হয়।২ আল্লামা কাযী শওকানী৩ (মৃঃ ১২৫০ হিঃ-১৮৩৮
খ্রীঃ) এ প্রসঙ্গে বলেনঃ
وانتفع الناس بتصابيفه لا سيما بالتفسير তাঁর রচিত
গ্রন্থাবলী দ্বারা বিশেষতঃ তাফসীর দ্বারা জনগণ লাভবান ও উপকৃত হয়।
এছাড়া তাঁর সম্বন্ধে আরও
বলা হয়েছেঃ .
كان مقربا وراويا للحديث
موثوقا كما كان مفسرا ومؤرخا معروفا
--
১. আল্লামা হাফিয যাহাবীঃ
তাযকিরাতুল হুফফার (দায়িরাতুল মাআরিফ হায়দরাবাদ ডেকান)পৃঃ ৭১।
২. ইবনু হাজার আসকালানীঃ ‘আদদুরারুল কামীনাহ’ঃ পৃঃ ২৮৬।
৩. এই প্রখ্যাত মনীষীর
আসল নাম মুহাম্মদ এবং উপনাম আবু আলী। ইনি ১১৭৩ হিজরীতে সান্আ নগরে জন্মগ্রহণ করেন। সানআর অনতিদূরে পর্বত
সংলগ্ন এই ‘শওকান’ নামক ক্ষুদ্র শহরটি
অবস্থিত। তিনি স্বীয় পিতা এবং আল্লামা কাওকাবানী প্রমুখের কাছে বিদ্যা শিক্ষা করে
ছাত্রাবস্থাতেই অধ্যাপনা ও ফতওয়া প্রদানের কাজ আঞ্জাম দিতে শুরু করেন। ১৩১০ হিঃ
তিনি স্বীয় শিক্ষকবৃন্দের ইঙ্গিতে ও পরামর্শক্রমে ‘মুনতাকাল আখবার' নামক বিখ্যাত গ্রন্থখানির
এক সুচিন্তিত ও অনুপম ভাষ্য লিখে ৮ খণ্ডে প্রকাশ করেন। এর নাম ‘নায়নূল আওতার’। সর্বপ্রথম এটি ২০ খণ্ডে
লিপিবদ্ধ হয়েছিল। পরে সংক্ষেপিত হয়। এছাড়া আরও ১১৬খানি গ্রন্থের তিনি লেখক ও
সংকলক। ইয়ামেনের প্রধান বিচারপতি ইয়াহইয়া বিন সালেহর মৃত্যুর পর খলিফা মানুসর
বিল্লাহ কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে ১২০৯ হিঃ তিনি উক্ত পদ গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে
বেশ সূচারুরূপে তিনি এই মহান দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে ফিরকায়ে যয়দিয়া এবং গোঁড়া শিয়া সম্প্রদায় তার
বিরোধিতায় বেশ তৎপর হয়ে উঠে। তাঁর প্রতি তারা নানারূপ কটুক্তি, অকথ্য অশ্রাব্য গালি এবং
মিথ্যা দোষারোপ করে ভীষণ আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু রাজ দরবারের আনুকূল্য ও
হস্তক্ষেপ হেতু বিরোধিদের কেউ সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে সাহস করেনি। পরিণামে সত্য
জয়যুক্ত এবং মিথ্যা পর্যুদস্ত হতে বাধ্য হয়। আল্লামা শওকানীকৃত ‘আল বাদরুত্তালে’ ‘দালীলু তালিব’, ‘দুরারুল বাহিয়াহ’, ‘ইরশাদুল গাবী ইলা মাযহাবি
আহলিল বাইত ফী সাহাবিন্নাবী', ‘হাশিয়া তালাবুল আদাব', ‘কাওয়াইদুল মাজমুয়া' প্রভৃতি গ্রন্থাবলীর
মাধ্যমে তাঁর জীবন-কথা ও দৃষ্টি ভঙ্গী সম্পর্কে জানা যায়। তাঁর দুইজন ছাত্র
আল্লামা নওয়াব সিদ্দীক হাসান খাঁর যুগে ইয়ামেন থেকে
পাক-বাংলা ভারতের ভূপাল নগরে আগমন করেন। এদের একজন হচ্ছেন যয়নুল আবেদীন বিন
মুহসিন আনসারী এবং অপরজন শাইখ হুসাইন বিন মুহসিন আনসারী। এঁরা উভয়েই ছিলেন সে
যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, মুফাসসির। এঁদের এবং
ভূপালের নওয়াব সিদ্দীক হাসান মরহুমের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাক-বাংলা ভারতে কাযী
শওকানী সংকলিত গ্রন্থাবলী ও গ্রন্থের বিষয়বস্তুগুলো ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার
সুযোগ লাভ করে। তার সন্তানদের মধ্যে তিনজন মনীষার ক্ষেত্রে বিশেষ সুনাম
অর্জন করেছিলেন। এরা হচ্ছেন আলী বিন মুহাম্মদ, আহমদ বিন মুহাম্মদ এবং
ইয়াহিয়া বিন মুহাম্মদ শওকানী। ২য় পুত্র পিতার সমস্ত ফতোয়াগুলোকে ১২৬২ সনে 'আল-ফাতহ রাব্বানী' নাম দিয়ে সংগৃহীত করেন।
--
অর্থাৎ তিনি ছিলেন একজন
শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদানকারী, হাদীসের বর্ণনাকারী
হিসেবে ছিলেন নির্ভরযোগ্য, যেমন তিনি ছিলেন প্রখ্যাত
তাফসীরকার এবং ঐতিহাসিক।
তাঁর রচিত সর্বজনপ্রিয়
গ্রন্থাবলী ও পুস্তক-পুস্তিকার মধ্যে যেগুলোর আমরা হদিস খুঁজে পেয়েছি, নিম্নে তার মোটামুটি একটা
তালিকা প্রদত্ত হলোঃ
(১) التكميل
فى معرفة الشقات والضعفاء والمخاعيل ‘আত্তাকমিলাহ্ ফী মা'রিফাতিস সিকাত ওয়াযযুআ'ফায়ে ওয়ালমুজাহিল'। হাজী খলীফা মোল্লা কাতিব
চাল্পী তাঁর অমর গ্রন্থ 'কাশফুয যুনূনে' এই গ্রন্থখানির ‘আত্তাকমিলাহ্ ফী আসমাইস সিকাত
ওয়াযযুআ’ফা’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু স্বয়ং গ্রন্থকার তার ‘আল বিদায়াহ ওয়ান
নিহায়াহ' গ্রন্থে এবং ‘ইখতেসারু উলূমিল হাদীস’ নামক অনবদ্য পুস্তকে উপরোক্ত
নামেই উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটির নাম থেকেই তার আলোচ্য বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটা
স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট ধারণা জন্মে। এটি রিজাল শাস্ত্রের (চরিত-অভিধান শাস্ত্র বা
রাবীদের জীবনী সংগ্রহ বিজ্ঞান) একখানি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। আল্লামা ‘হুসাইনী' দিমাশকীর আলোচনা মতে এই আলোচ্য
গ্রন্থ পাচ খণ্ডে সমাপ্ত হয়েছে।১ লেখক এতে হাফিয জামাল
ইউসুফ বিন আবদুর রহমান মিয্যীর ‘তাহযীবুল কামাল’ এবং হাফিয শামসুদ্দীন যাহাবীর ‘মীযানুল ই'তিদাল' নামক চমৎকার
গ্রন্থদ্বয়কে একত্রিত করেছেন। শুধু তাই নয়, নিজের পক্ষ থেকে বহু মূল্যবান তথ্য সংযোজন করে বেশ
পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশ করেন। গ্রন্থকার স্বয়ং অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেনঃ
هو أنفع شينا للفقيه البارع
و كذالك للمحدث
‘আলোচ্য গ্রন্থখানি বিশেষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শাস্ত্রবিদের জন্য যেমন লাভজনক, ঠিক তেমনি মুহাদ্দিসের
পক্ষেও উপকারী।
(২) الهدى
والسنن فى احاديث المسانيد و السنن ‘আল-হাদয়ু ওয়াস সুনান ফী
আহাদিসিল মাসানীদে ওয়াস সুনান'। এই গ্রন্থখানি ‘জামিউল মাসানিদ’ নামেও প্রসিদ্ধ। এতে ‘মুসনাদ আহমাদ বিন হাম্বাল’, ‘মুসনাদ বাযযার’, ‘মুসনাদ আবূ ইয়ালা’, ‘মুসনাদ ইবনু আবি শায়বা', এবং সিহাহ সিত্তার
রিওয়ায়িতগুলোকে একত্র করে বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করা
হয়েছে।
--
১. আবুল মাহাসিন হুসাইনী
দিমাশকীঃ যাইলু তাযকিরাতিল হুফ্ফায (দিমাশক থেকে
মুদ্রিত) পৃঃ ১৫৪; নওয়াব সিদ্দকী হাসান খাঁঃ আবজাদুল উলুম’ ৩য় খণ্ড (ভূপালের
সিদ্দীক প্রেস থেকে মুদ্রিত) পৃঃ ৭৮০; আহমদ শাকির সম্পাদিত ‘শারাহ ইখতিসার উলুমিল হাদীসের’ শুরুতে আবদুর রহমান হামযার মুকাদ্দিমাঃ পৃঃ ১৭।
--
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত
মুহাদ্দিস আল্লামা কাওসারী১ (মৃঃ ১৩৭১ হিঃ-১৯৫১
খ্রীঃ)। বলেনঃ ‘হুয়া মিন আনফায়ি
কুতুবিহি'- অর্থাৎ এই আলোচ্য
পুস্তকটি গ্রন্থকারের অত্যন্ত উপকারী গ্রন্থাবলীর অন্যতম'। এর হস্তলিখিত একটি কপি
মিসরের ‘দারুল কুতুবিল মিসরিয়া’য় সংরক্ষিত রয়েছে।
(৩) طبقات
الشافعية ‘তাবাকাতুশ শাফিঈয়াহ’। এই গ্রন্থে শাফি'ঈ ফকীহদের বিস্তারিত
বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। এর হস্তলিখিত একটি কপি শাইখ আবদুর রাযযাক হামযাহ (ইমাম ইবনু
কাসীরের জীবনীকার) শাইখ হুসাইন বসালামার কাছে স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেছেন।
(৪)مناقب
اشافعى মানাকিবুশ শাফিঈ' এই পুস্তকে ইমাম২ শাফিঈর (মৃঃ ২০৪ হিঃ-
৮২০ খ্রঃ) অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। লেখক তাঁর অনবদ্য অবদান ‘আল-বিদায়াহ
ওয়ান্নিহায়াহ’-এর মধ্যে ইমাম শাফিঈর
বিবরণ দিতে গিয়ে এই আলোচ্য পুস্তকেরও উল্লেখ করেছেন। এর হস্তলিখিত কপিটি ‘তাবাকাতুশ শাফিঈয়ার
সঙ্গে সংযুক্ত ও একত্রিত। হাজী খলীফা তাঁর কাশফুযযুনূন' গ্রন্থে এই পুস্তকটির নাম
الواضع
النفيس فى مناقب الامام ابن ادريس ‘আল ওয়াযিহুন নাফীস ফী
মানাকিবিল ইমাম ইবনি ইদ্রীস বলে উল্লেখ করেছেন।
(৫) تخريج احاديث ادلة التنبية ‘তাখরীজু আহাদীসি আদিল্লাতিৎ তামবীহ'।
(৬) تخريج احاديث مختصر ابن الحاجب ‘তাখরীজু আহাদীসি মুখতাসার
ইবনিল হাজিব’ গ্রন্থকার তাঁর ছাত্র
জীবনে প্রাথমিক পর্যায়ে ইবনুল হাজিরের৩
--
১. পুরো নাম যাহিদ বিন
হাসান আল-কাওসারী (মৃঃ ১৩৭৪ হিঃ-১৯৫১ খ্রীঃ) তিনি এ যুগের একজন প্রখ্যাতনামা
মনীষী। প্রথমে ইস্তাম্বুল ও পরে মিসরের কাইরোর অধিবাসী হয়েছিলেন। মুসতাফা কামাল
কর্তৃক ইস্তাম্বুল থেকে নির্বাসিত হয়ে মিসরের মাটিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি
হাদীস বিষয়ক গ্রন্থমালার লেখক ও পত্রিকার সম্পাদক।
২. ‘আসকালান' কিংবা মক্কার মিনায় তাঁর
জন্ম (১৫০ হিঃ-৭৬৭ খৃঃ) ৭ বছর বয়সে কুরআন হেফয করে মক্কার মুফতীয়ে আজমের কাছে ফিকাহ শাস্ত্র শিক্ষা
করেন। অতঃপর মদীনা গিয়ে ইমাম মালেকের ছাত্র হন। কিন্তু তিনি ইমাম আহমাদের (রহঃ)
আবার শিক্ষকও ছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সমসাময়িক উলামা তাঁকে ফতওয়া দানের
অনুমতি দেন। শেষ জীবন তিনি মিসরে অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন (২০৪
হিঃ-৮২০ খ্রীঃ)। ফিকাহ শাস্ত্রে সে যুগে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। উপরন্তু তিনি
একজন কবিও ছিলেন। তার মোট গ্রন্থের সংখ্যা ১১৪টি। তন্মধ্যে ‘কিতাবুল উম্ম' তার অবিস্মরণীয় অনবদ্য
অবদান। এতে বহু সংখ্যক হাদীস রয়েছে। মুসনাদ তার একটি স্বতন্ত্র হাদীস গ্রন্থ।
গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে তিনি যে
কোন ত্যাগ ও শ্রম স্বীকার করতে সদা প্রস্তুত থাকতেন।
৩. ইবনু হাজিবের উপরিউক্ত
গ্রন্থ দু’টির ভাষ্য বা শরাহ
লিখেছেন আল্লামা শামসুদ্দীন মাহমুদ বিন আবদুর রহমান ইস্পাহানী। এই ভাষ্যকারের
কাছ থেকেই ইবনু কাসীর আলোচ্য গ্রন্থদ্বয় পড়েছিলেন এবং অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের আলোকে
তিনি উভয় গ্রন্থেরই বর্ণনাসূত্র বিস্তারিতভাবে প্রদান করেছেন।
--
‘তামবী ‘ ও ‘মুখতাসার’ নামক সংক্ষিপ্ত
পুস্তকদ্বয় কণ্ঠস্থ করেছিলেন-সে যুগের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী।
(৭) شرح
صحيح البخارى ‘শারহু সাহীহিল বুখারী'। গ্রন্থকার ইবনু কাসীর
বুখারী শরীফের এই ভাষ্যটি লিখতে শুরু করেছিলেন এবং এ কাজে বেশ কিছুদূর তিনি অগ্রসর
হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। হাজী খলীফা তাঁর ‘কাশফুয্যুনূন’ গ্রন্থে বলেন যে, এটি শুধুমাত্র প্রাথমিক অংশেরই ভাষ্য। গ্রন্থকার তাঁর ‘ইখতিসারু উলুমিল হাদীস’ গ্রন্থে এই ভাষ্যটির
উল্লেখ করেছেন।
(৮)الاحكام
الكبير ‘আল-আহকামুল কাবীর'। এ গ্রন্থখানিতে তিনি
শুধুমাত্র আহকাম বা অনুশাসন সম্পর্কিত হাদীসগুলোকে বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করতে শুরু
করেছিলেন। কিন্তু ‘কিতাবুল হজ্জ’ পর্যন্ত পৌঁছে আর
বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেননি। ইবনু কাসীর তার ‘ইখতিসারু উলুমিল হাদীস’ গ্রন্থে এর উল্লেখ
করেছেন। মাওলানা নুর মুহাম্মদ আজমী সাহেব ‘আহকামে সুগরা' নামে তাঁর আরও একটি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে অন্যান্য হাদীসবেত্তাদের অনুকরণে
হাফিয ইবনু কাসীর ‘আহ্কামে উসতা' নামকরণে এ জাতীয় কোন
গ্রন্থ প্রণয়ন করেননি।১
(৯) اختصار
علوم الحديث ‘ইখতিসারু উলুমিল হাদীস’ আল্লামা নওয়াব সিদ্দীক হাসান খাঁ ভূপালী তার ‘মিনহাযুল উসূল ফী ইসতিলাহি আহাদীসির্ রাসূল' গ্রন্থে এর নাম الباعث
الحديث على معرفة علوم الحديث ‘আল বাইসুল হাদীস ‘আলা মা'রিফাতে উলূমিল হাদীস' বলে উল্লেখ করেছেন। এটি
আল্লামা ইবনুস সালাহ (মৃঃ ৬৪৩ হিঃ) লিখিত সুপ্রসিদ্ধ উসূলুল হাদীসের কিতাব ‘উলূমিল হাদীস’ ওরফে ‘মুকাদ্দিমা ইবনুস সালাহ' مقدمة
ابن الصلاح গ্রন্থের সংক্ষিপ্তসার। গ্রন্থকার ইবনু কাসীর এর স্থানে স্থানে বহু সুন্দর জ্ঞাতব্য
বিষয় বিশদভাবে সংযোজন করেছেন। হাফিযু ইবনু হাজার আসকালানী এই গ্রন্থ সম্পর্কে
বলেনঃله
فيه فواءد অর্থাৎ বহু উপকারী বিষয়বস্তুর সমাবেশ এতে রয়েছে। এই
উপকারী বিষয়গুলো সবই ইবনু কাসীরের সংযোজনকৃত। এটি কতবার কত দেশের কত প্রেস থেকে
যে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে সত্যিই তার ইয়ত্তা নেই। আমার কাছে সংরক্ষিত যে নতুন
সংস্করণটি রয়েছে তা
--
১. মাওলানা নূর মোহাম্মদ
আজমীঃ ‘হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস’ ২য় মুদ্রণঃ ঢাকা, ১৯৭৫ঃ পৃঃ ১২৯ ; আবুল কাসেম মুহাম্মদ হোসাইন
বাসুদেবপুরীঃ হাফিয ইবনে কাসীরঃ মাসিক তরজমানুল হাদীস, একাদশ বর্ষ ২য় সংখ্যা
পৃঃ ৭৪; মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানীর
‘হায়াতু ইবনু কাসীর' (উর্দু প্রবন্ধ)ঃ মাওলানা
মুহাম্মদ সাহেব জুনাগড়ী অনূদিত উর্দু তাফসীরে ইবনু কাসীরের শুরুতে প্রকাশিত পৃঃ
৯।
--
নিখুঁতভাবে মুদ্রিত
হয়েছে ‘দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া’ বৈরুত থেকে। এর মোট
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৫২। আসলে এটি ইখতিসাৰু উলূমিল হাদীসের শারাহ বা ভাষ্য। এটি
সুন্দরভাবে এডিট করেছেন আহমদ মুহাম্মদ শাকির। এর শুরুতে রয়েছে শাইখ মুহাম্মদ
আবদুর রায্যাক হামযাহ কৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং হাফিয ইবনু
কাসীরের সংক্ষিপ্ত জীবন কথা।
(১০) مسند
اشيخين ‘মুসনাদুস শাইখাইন'। এতে হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত
হাদীসসমূহ সংগৃহীত হয়েছে। গ্রন্থকার ইবনু কাসীর (রহঃ) তাঁর ইখতিসারু ‘উলুমিল হাদীস' গ্রন্থে আর একখানি ‘মুসনাদে উমর' নামক গ্রন্থের কথা উল্লেখ
করেছেন। কিন্তু এটা একটা স্বতন্ত্র গ্রন্থ, না উপরিউক্ত গ্রন্থেরই দ্বিতীয় খণ্ড তা সঠিকভাবে জানা যায়
না ।
(১১)السيرة
النوية ‘আসসীরাতুন নবভীয়াহ'। এ একখানি বৃহদাকার উৎকৃষ্ট সীরাত গ্রন্থ। -
১২) الفصول فى اختصار سيرة الرسولو ‘আল-ফুসূল ফী ইখতিসারি সীরাতির রাসূল'। এটি হযরত রসূলে আকরাম
(সঃ)-এর একখানি সংক্ষিপ্ত জীবনী গ্রন্থ। হাফিয ইবনু কাসীর স্বয়ং তাঁর তাফসীরে
সূরা আল আহযাবে' খন্দক বা পরিখা যুদ্ধের
বর্ণনা প্রসঙ্গে এই গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। এর একখানি হস্তলিখিত কপি মদীনা
মুনাওয়ারার ‘শাইখুল ইসলাম' গ্রন্থাগারে আজও সংরক্ষিত
রয়েছে।
(১৩) كتاب
المقدمات ‘কিতাবুল মুকাদ্দিমাত'। গ্রন্থকার স্বীয় ইখতিসারু ‘উলুমিল হাদীস' গ্রন্থে এর উল্লেখ
করেছেন। এছাড়া ‘মুখতাসারু মুকাদ্দিমা
ইবনুস সালাহ্’ গ্রন্থেও তিনি এর বরাত
দিয়েছেন।
(১৪) مختصر
كتاب المدخل للامام بيهقى ‘মুখতাসারু কিতাবুল মাদখাল লিল ইমাম
বাইহাকী'। এই গ্রন্থের নাম
গ্রন্থকার স্বয়ং ‘ইখতিসারু উলুমিল হাদীস’-এর ভূমিকায় উল্লেখ
করেছেন। এটি ইমাম আহমদ বিন হুসাইন আল বাইহাকী (৪৫৮ হিঃ) কৃত ‘কিতাবুল মাদখালে’র সংক্ষিপ্ত সার।
(১৫)رسالة
الاجتهاد طلب الجهاد 'রিসালাতুল ইজতিহাদ ফী তালাবিল জিহাদ'। খ্রীষ্টানরা যখন ‘আয়াস' দূর্গ অবরোধ করে সেই
সময়ে তিনি এই পুস্তিকাখানি আমীর মনজাকের উদ্দেশ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এটি মিসর
থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
(১৬) رسلة
فى فضاءل القران “রিসালাতুন ফী ফাযায়িলিল কুরআ ’।এটি মিসরের ‘আল-মানার’ এবং অন্যান্য প্রেস থেকে
তাফসীর ইবনু কাসীরের সাথে এর পরিশিষ্ট হিসেবে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশ লাভ করেছে।
বুলাক প্রেস থেকে মুদ্রিত কপিতে এই পুস্তিকাটি নেই। গ্রন্থকারের যে কপির সঙ্গে
মক্কা শরীফের কপিটি মিলানো হয়েছে তাতে এটি পাওয়া যায়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৮। এটি হাদীস ও
কুরআনের আলোকে লিপিবদ্ধ অত্যন্ত প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য পুস্তক।
(১৭) مسند امام
احمد بن حنبل
‘মুসনাদ ইমাম আহমদ ইবনু হামবাল’ মহামতি ইমাম আহমদ
ইবনু হামবালের (রহঃ) বিরাট বিশাল মুসনাদ গ্রন্থখানিকে বর্ণমালার ক্রম অনুযায়ী
সাজিয়ে গুছিয়ে সুবিন্যস্ত করে এবং তার সঙ্গে ইমাম তাবরানীর মু'জাম ও আবু য়া’লার মুসনাদ থেকে অতিরিক্ত হাদীসগুলো তার মধ্যে সন্নিবেশিত করে এই গ্রন্থখানি
সংকলিত হয়েছে।
(১৮) البداية و النهاية ‘আল বিদায়া ওয়ান-নিহায় ‘। ইবনু কাসীর রচিত
ইতিহাস বিষয়ক এই বিরাট গ্রন্থখানি তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি।মিসর থেকে একাধিকবার এটি
মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এতে সৃষ্টির প্রাথমিককাল থেকে শুরু করে শেষ যুগ
পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা ও অবস্থার কথা সুন্দরভাবে সবিস্তারে বিধৃত হয়েছে। প্রথমে নবী
ও রাসূলগণ ও পরে প্রাচীন জাতির তথা বিগত উন্মতদের বিস্তারিত বিবরণ এবং শেষে সীরাতে
নবভী (সঃ)-এর বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। তারপর খিলাফতে রাশেদা থেকে শুরু করে একেবারে
গ্রন্থকারের সময়কাল পর্যন্ত বিস্তৃত ঐতিহাসিক তত্ত্ব ও তথ্যাবলী সুন্দর ও
স্বার্থকভাবে বর্ণিত হয়েছে। আর সেই সঙ্গে বিধৃত হয়েছে এই পৃথিবীর লয়প্রাপ্তি
তথা রোয কিয়ামতের আলামতসমূহ এবং আখিরাত বা পরজগতের অবস্থার কথাও ব্যাপক ও
বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। হাজী খলীফা তার সুপ্রসিদ্ধ কাশফুযযুনূন’ গ্রন্থে বলেনঃ
اعتمد في تقله على النص من الكتاب و السنة فى وقائع الألوف السايفة وميز
بين الصحيع و السقيم والخبر الإسرائيلى وغيره (کشف الظنون)
অর্থাৎ ‘পূর্বকালের শত সহস্র বছরের ঘটনাসমূহের বিবরণ পবিত্র কুরআন ও শাশ্বত সুন্নাহর
বর্ণনার উপর ভিত্তি করে পেশ করা হয়েছে এবং সহীহ ও দুর্বল এবং ইস্রাঈলীয়
রেওয়ায়েতগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে দেখানো হয়েছে'।
মোটকথা ইমাম ইবনু কাসীর
এই অনবদ্য ইতিহাস গ্রন্থের ‘ইস্রাঈলিয়াত’ বা, অলীক ও আজগুবি
ঘটনাসমূহকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার করেছেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক তাগরী বিরদী আলোচন্য
গ্রন্থ সম্পর্কে বলেনঃ هو فى غاية
الجودة
অর্থাৎ ‘গ্ৰন্থখানি অতীব চমৎকার’।
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার আল্লামা হাফিয বদরুদ্দীন মাহমুদ ‘আইনী রচিত ইতিহাস
গ্রন্থটির অধিকাংশই এ গ্রন্থকে অবলম্বন ও ভিত্তি করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া
তাঁর অন্যান্য উত্তরসূরীরাও একে সামনে রেখে তাদের নিজ নিজ ইতিহাসকে অপেক্ষাকৃত
সুন্দর করে প্রণয়ন করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আল্লামা হাফিয ইবনু হাজার
আসকালানী আলোচ্য গ্রন্থের একখানি সুন্দর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রণয়ন করেন।
আল্লামা হাফিয ইবনু কাসীর
তার অবধারিত মৃত্যুর দুই বছর আগ পর্যন্ত সংঘটিত সমস্ত ঘটনাবলীকে সবিস্তারে বর্ণনা
করেছেন। বিশেষ করে এতে সীরাতুন্নবী অংশকে বেশ চমৎকার ও সার্থকভাবে উপস্থাপিত করা
হয়েছে।
(১৯) تفسير القران الكريم ‘তাফসীরুল কুরআনিল
কারীম’ বা ‘তাফসীর ইবনু কাসীর’। পবিত্র কুরআনের এই সুপ্রসিদ্ধ ভাষ্য গ্রন্থ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লামা সুয়ূতী
(রহঃ) বলেন, لم يولف على
نمطه مثله অর্থাৎ এ ধরনের অন্য কোন তাফসীর লিপিবদ্ধই হয়নি। কায়রোর প্রখ্যাত আলেম যাহিদ
বিন হাসান আল-কাউসারী আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতীর বরাতে বলেন هو من افيد كتب التفسير بالرواية ‘রিওয়ায়েতের বিশিষ্ট তাফসীরসমূহের মধ্যে এটি হচ্ছে সবচেয়ে কল্যাণপ্রদ ও
উপকারী।১
সত্য কথা বলতে কি, হাফিয ইবনু কাসীর
সর্বমোট যে বিশটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, তন্মধ্যে এই
তাফসীরুল কুরআনিল কারীমই তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি, অবিস্মরণীয় ও অমর অবদান। এর প্রতি খণ্ডের পাতায় পাতায় পরিস্ফুট রয়েছে
নিরবচ্ছিন্ন কঠোর পরিশ্রম, গবেষণা সুলভ
অনুসন্ধিৎসা, অধ্যয়ন ও সুগভীর
পাণ্ডিত্যের ছাপ।
এমনিতেই প্রাচীন যুগে
রচিত তাফসীর গ্রন্থের বহুলাংশই আজ অনন্ত কাল সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। আজ তাদের অস্তিত্ব এই পৃথিবীর কোন অংশেই খুঁজে পাওয়া
যাবে না। আবার এমন কতগুলো তাফসীর গ্রন্থও রয়েছে যেগুলো এখনও হস্তলিখিত
পাণ্ডুলিপির আকারে আবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে যেসব গুরুত্বপূর্ণ তাফসীর
গ্রন্থ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়ে দিনের আলো দেখতে সক্ষম হয়েছে তন্মধ্যে এই আলোচ্য ‘তাফসীর ইবনু কাসীর’ বিশেষ উল্লেখের দাবীদার। ‘তাফসীরে মান্কূল' বা রিওয়ায়িতমূলক
তাফসীরসমূহের মধ্যে এটি হচ্ছে সময়ের দিক দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের। প্রথম
পর্যায়ের তাফসীর হলো তাফসীর ইবনু জারীর তাবারী। তাফসীর ইবনু কাসীরের মধ্যে
অন্যান্য তাফসীরসমূহের বৈশিষ্ট্যগুলোর সংযোগ ও সমন্বয় সাধিত হয়েছে। অকট্য দলীল
প্রমাণ দ্বারা মাসয়ালাসমূহকে প্রতিপন্ন করার দিক থেকে এক দিকে যেমন এতে তাফসীর
ইবনু জারীর তাবারীর বৈশিষ্ট্যের ছাপ রয়েছে, তেমনি অপূর্ব ভাষা শৈলী ও বর্ণনা পদ্ধতির লালিত্যের দিক দিয়ে তাফসীর কুরতুবী
ও মা‘আলিমুত্ তানযীলের সমকক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আরবী শব্দমালার পার্থক্যসহ
প্রতিটি হাদীসের ‘সিলসিলায়ে সনদ’ বা বর্ণনাক্রম দ্বারা নির্ভরযোগ্য করে এর গুরুত্ব ও মূল্য বহুল পরিমাণে
বর্ধিত করা হয়েছে। এছাড়া
--
১. শাইখ মুহাম্মদ আবদুর
রাযযাক বিন হামযাহঃ তরজুমাতুল ইমাম ইবনু কাসীরঃ ২য় সংস্করণ, দারুল কুতুব, বৈরুতঃ পৃঃ ১৬, ডঃ মুহাম্মদ হুসাইন
যাহবীর ‘আত্তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরূনঃ ১ম খঃ, ২য় সংস্করণঃ ১৯৭৬, দারুল কুতুবঃ পৃঃ
২৪৪; মাওলানা আলীমুদ্দীন ‘আরবী ভাষায়
কুরআনের তাফসীরঃ’ সাপ্তাহিক আরাফাতঃ ১১শ বর্ষ, কুরআন সংখ্যা।
--
বিভিন্ন অবস্থা ও
পরিবেশের প্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআনের দুর্বোধ্য ও জটিল অংশগুলোর বিশদ ব্যাখ্যা
ছাড়াও এতে দ্ব্যর্থবোধক শব্দমালার রয়েছে। আভিধানিক তাৎপর্য ও শাস্ত্রীয়
বিশ্লেষণ। আরও রয়েছে এতে শানিত যুক্তির সূক্ষ্ম মানদণ্ডে এবং কষ্টি পাথরে যাচাই
করে অকাট্য দলীল প্রমাণের আলোকে কতগুলো ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডন। মোটকথা, এটি বিদআত থেকে
মুক্ত এবং কুরআন ও সুন্নাহর অধিকতর নিকটবর্তী। এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষ্য গ্রন্থের
কোথাও দুরূহতা বা জটিলতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়নি। প্রায় সর্বত্রই বর্ণনা রীতির
পারিপাট্য, ভাষার স্বচ্ছতা ও
সাবলীলতা এবং প্রাঞ্জলতার জন্যে আলোচনা হয়েছে প্রাণবন্ত। বিতর্কমূলক বিষয়ে হাফিয
ইবনু কাসীর (রহঃ) বৈজ্ঞানিকের নিরাসক্তি ও ঐতিহাসিকের নির্লিপ্ততা রক্ষা করতে প্রয়াস
পেয়েছেন। হাদীস ভিত্তিক তত্ত্ব ও তথ্যই এসব ক্ষেত্রে তাকে আলোক বর্তিকা হাতে
নিয়ে পথ দেখিয়েছে। কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি তথ্য বিচার
বিশ্লেষণ দ্বারা তাঁর। অভিমতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু কোথাও ভাবাবেগ
দ্বারা পরিচালিত ও প্রভাবান্বিত হয়েছেন বলে মনে হয় না।
এ কথা সত্য যে, হাফিয ইমাদুদ্দীন
ইবনু কাসীর আলোচ্য তাফসীরে তার পূর্বসূরী ইবনু জারীর তাবারীর রচনা রীতি, ঐতিহাসিক ভাবধারা ও
দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণ করেছেন। কিন্তু তাবারীর তাফসীরে ‘ইস্রাঈলিয়াত' নামক যেসব
অপ্রামাণ্য ও জাল হাদীস ভিত্তিক উপাখ্যান ও বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে। সেগুলোকে
যাচাই বাছাই করে ইবনু কাসীর বিশুদ্ধ হাদীসের আলোকে একে নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ, তাফসীরে পরিণত করার
প্রয়াস পেয়েছেন।
বলা বাহুল্য, এসব ন্যায়সঙ্গত কারণেই একে ‘তাফসীরে সালাফী' নামে অভিহিত করা
হয়।১
এই সর্বজনপ্রিয় বিরাট
তাফসীর গ্রন্থখানি সর্বপ্রথম মিসরের বোলাক প্রেস থেকে ১৩০১ হিঃ মুতাবেক ১৮৮৩
খৃষ্টাব্দে আল্লামা নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (মৃঃ ১৩০৭ হিঃ -১৮৮৯খৃঃ) কৃত তাফসীর ‘ফাতহুল বায়ানে’র হাশিয়ায় মোট ১০ খণ্ডে সমাপ্ত হয়ে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। অতঃপর এটি
আল্লামা হুসাইন বিন মাসউদ আল-ফাররা আল-বাগাভী (মৃঃ ৫১৬ হিঃ -১১২২খৃঃ) কৃত তাফসীর ‘মাআলীমুত্ তানযীলে’র সঙ্গে মিসরের কোন এক প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত
হয়। তারপর ১৩৫৬ হিজরী মুতাবেক ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দে এটি আলাদাভাবে মিসরের আল-হালাবী
প্রেস থেকে বড় বড় চার খণ্ডে ছাপা হয়ে প্রকাশিত হয়। এছাড়া আরও কয়েকবার একাধিক
স্থান থেকে এটি প্রকাশিত
--
১. আঃ কাঃ মুহাম্মদ
আদমুদ্দীনঃ ‘ইলমে তাফসীর’ঃ আজাদ ঈদ সংখ্যাঃ ১৩৫৩/১৯৪৬ খ্রীঃ পৃঃ ৭৩; শাইখ আবদুর রাযযাক
হামযাহঃ মুকাদ্দিমা ইখতিসারু উলুমিল হাদীস ওয়া তরজমাতুল মুয়াল্লিফ’ঃ দারুল কুতুব, বৈরুতঃ পৃঃ ১৬-১৭, ডঃ মুহাম্মদ হুসাইন
যাহাবীঃ আত্তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরূনঃ ১ম খণ্ড ২য় সংস্করণঃ দারুল কুতুবিল হাদীসিয়াহঃ ১৯৭৬ সালঃ পৃঃ ২৪৪; মাওলানা
আলীমুদ্দীনঃ আরবী ভাষায় কুরআনের তাফসীরঃ সাঃ ‘আরাফাত’ পৃঃ ৭০-১১ শ বর্ষঃ
১৯শে ফেব্রুয়ারীঃ ১৯৬৮ঃ
--
হয়। সর্বশেষে মরহুম শাইখ
আহমদ শাকির এই তাফসীরের মধ্যে উল্লিখিত হাদীসমূহের সনদ বা বর্ণনাসূত্রকে বাদ দিয়ে
মিসর থেকে প্রকাশ করেন। তাফসীর ইবনু কাসীরের অপূর্ব জনপ্রিয়তা ও গুরুত্বের কথা
অনুধাবন করে মহাগুজরাট প্রদেশের অন্তর্গত কাথিয়াওয়াড় এলাকার মাওলানা মুহাম্মদ জুনাগড়ী১ একে উর্দুতে ভাষান্তরিত করেন। এই উর্দু অনুবাদ প্রথমে ‘আখবারে মুহাম্মদী' নামক দিল্লী থেকে
তার সম্পাদনায় প্রকাশিত এক পাক্ষিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। অতঃপর
গ্রন্থকারের বিভিন্ন খণ্ডে প্রকাশিত হতে শুরু হয় ১৩৫০ হিঃ মুতাবিক ১৯৩১ সালের
প্রথম দিকে। এখন এটি একই সঙ্গে পাক-ভারতের বহু প্রেস থেকে হাজার হাজার কপি করে
মুদ্রিত হচ্ছে। আর কাটতিও হচ্ছে প্রচুর।
--
১. বোম্বাই প্রদেশের
(বর্তমান মহাগুজরাট প্রদেশের অন্তর্গত কাথিয়াওয়াড় এলাকার নাগড় শহরে সম্ভ্রান্ত
ও প্রসিদ্ধ মাইমান বংশে তার জন্ম। পিতা ইবরাহীম সাহেব ও মাতা হাওয়া বিবি ছিলেন
উচ্চ সম্ভ্রান্ত বংশীয়া। ২২ বছর বয়সে জুনাগড়ের বুক থেকে দিল্লীর মাটিতে আগমন
করে তিনি লেখা পড়া শুরু করেন। শিক্ষা সমাপনান্তে কর্মজীবনে প্রবেশ করে এখানেই
তিনি ‘মাদ্রাসা মুহাম্মদীয়া' নামে একটি নির্ভেজাল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বুনিয়াদ পত্তন করেন। ১৯৪২ সাল
পর্যন্ত এই শিক্ষায়তন দেশ-বিদেশের বহু জ্ঞান পিপাসুকে জ্ঞানালোক দান করেছে। ১৯২১
সালে দিল্লী থেকে তিনি 'আখবারে
মুহাম্মদীয়া' নামে একটি পাক্ষিক
পত্রিকা নিজস্ব সম্পাদনায় বের করেন। তার অনুবাদ ও অন্যান্য গ্রন্থাবলীর সংখ্যা
প্রায় দেড় শতেরও অধিক। এগুলোর মূল্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে এ থেকেই কিছুটা আঁচ করা
সম্ভব যে, লেখকের জীবদ্দশায়
কোন কোন বইয়ের নয় দশটি সংস্করণও বের হয়। এছাড়া তার বেশ কিছু বই বাংলা, ইংরেজী, গুজরাটি এবং
অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মৌলিক গ্রন্থাবলী ছাড়া অনুবাদ সাহিত্যে মওলানা
মুহাম্মদ সাহেব শুধু যে আড়াই হাজার পৃষ্ঠব্যাপী তাফসীর ইবনু কাসীরের তরজমা লিখেই
ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়, বরং প্রখ্যাত
মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মদ হায়াতকৃত ‘ফাতহুল গফুর ফী অজ্ইল আয়দী’, আল্লামা শাইখ
তাকীউদ্দীন সুবকী কৃত “রিসালা জুয্ই রাফ্ইল ইয়াদাইন' এবং শাইখুল ইসলাম
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিমের (রহঃ) ‘ইলামুল মুয়াক্বিয়ীন' প্রভৃতি
গ্রন্থমালাকেও উর্দুতে ভাষান্তরিত করেন। এই শেষোক্ত গ্রন্থটি পূর্ণ সাত খণ্ডে
সমাপ্ত। এটি প্রকাশ পাওয়া মাত্রই ইমামুল হিন্দ হযরত মাওলানা আবুল কালাম আযাদ
আনন্দে গদগদ চিত্তে অনুবাদককে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে কলকাতা থেকে একাধিকপত্র
প্রেরণ করেন। এই ঐতিহাসিক পত্রগুলো আজও উক্ত গ্রন্থের শুরুতে সন্নিবেশিত দেখতে
পাওয়া যায়।
আল্লাহ পাক মওলানা
মুহাম্মদ জুনাগড়ী সাহেবকে অনলবর্ষী ভাষণের এমন এক সম্মোহনী শক্তিদান করেছিলেন যে, তার বিষয়বস্তুর গুরুত্বে-ভাষার ওজস্বিতায় বর্ণনা মাধুর্যে, পারিপাট্ট্য ও কৌশলে সমবেত জনতা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত ও মন্ত্রমুগ্ধ না হয়ে পারতো না।
কুরআন ও হাদীসের অমিয় বাণী, সীরাতে নবী, ইসলামের ইতিহাস এবং
সালফে সালেহীনের ত্যাগপূতঃ আদর্শ জীবনের ঘটনাবলীই ছিল তার আগুনঝরা, বাগ্মিতাপূর্ণ ভাষণে প্রধান উপজীব্য। আরব ভূমিতে আবদুল আযীয ইবনে সউদের শাসনভার হাতে
নেওয়ার পর মু'তামারে আলামে
ইসলামীর এক অধিবেশন সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের সাথে তিনিও যোগদান
করেন।
অবশেষে ইসলামী শরীয়ত ও
জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই প্রদীপ্ত মশাল মওলানা মুহাম্মদ জুনাগড়ী ১৯৪১ খ্রঃ মুতাবিক
১৩৬০ হিঃ ১৩ই সফর জুমআর রাত্রে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার কারণে
স্বীয় জন্মভূমি জুনাগড় শহরে ইন্তিকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি
রাজেউন।
--
আলোচ্য তাফসীর ইবনু কাসীর
সম্পর্কে আল্লামা হাফিয আবু আলী মুহাম্মদ শওকানী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ-১৮৩৪ হিঃ) বলেনঃ
وقد جمع فيه فاوعى و نقل المذاهب و الأخبار و
الاثار و تكلم بأحسن كلام و انفسيه-
অর্থাৎ ‘আলোচ্য গ্রন্থে তিনি হাদীসের রেওয়ায়তগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে এমন
পূর্ণাঙ্গভাবে তা আহরণ করেছেন যে, তাতে ত্রুটি-বিচ্যুতির লেশমাত্রও নেই। অনুরূপভাবে তিনি এতে বিভিন্ন মাযহাব ও
মতবাদ, হাদীস এবং
সাহাবা-ই-কিরাম ও তাবিঈনের উক্তিসমূহ উদ্ধৃত করেছেন এবং প্রতিটি আলোচনা অতি
সূক্ষ্ম ও সুন্দরভাবে বিবৃত করেছেন’।
আলোচ্য তাফসীরের বিশেষত্ব এই যে, এতে কুরআন ভাষ্যের
মূলনীতির অনুসরণে সর্বপ্রথমে অপরাপর আয়াতের আলোকে তাফসীর করা হয়েছে। তারপর
হাদীসবেত্তাদের সুপ্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থমালায় উক্ত বিষয়ে যেসব হাদীস বর্ণিত
হয়েছে তা সনদসহ উদ্ধৃত করে প্রয়োজনবোধে সে হাদীসের সিলসিলায়ে সনদ বা বর্ণনাসূত্র
ও রিজাল বা হাদীসের রাভীগণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হাফিয ইবনু
কাসীরের এই তাফসীর অধ্যয়ন করে ভাষ্য সম্পর্কিত তাঁর অনুসৃত এই মূলনীতি সম্পর্কে
আমরা অবহিত হতে পেরেছি। বাস্তবিকই এরূপ দুরূহ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটির সূচারুরূপে
সমাধার জন্যে তার মতো সুযোগ্য ও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন কালজয়ী মুহাদ্দিসেরই প্রয়োজন
ছিল। আল্লাহ পাকের অশেষ
ধন্যবাদ যে, আল্লামা ইমাদুদ্দীন
ইবনু কাসীর (রহঃ) তাঁর জীবনব্যাপী একনিষ্ট সাধনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের অমৃতফল
হিসেবে এই দুরূহ কাজ সুসম্পন্ন করে দিয়ে তিনি সুধী সজ্জন তথা শিক্ষিত জগতের
প্রভূত কল্যাণ সাধন করে গেছেন। আগেই বলেছি আলোচ্য তাফসীরে তিনি
অন্যান্য তাফসীর ও ইতিহাস গ্রন্থ থেকে ‘ইসরাঈলী রিওয়ায়িত' গুলোকে সূক্ষ্ম সমালোচনার
মানদন্ড ও কষ্ঠিপাথরে যাচাই বাছাই করে তা সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে দিয়েছেন। এভাবে
তিনি একজন সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ সমালোচকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। এবং তাফসীর
সাহিত্যের ক্ষেত্রে এখানেই তিনি বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। একথা সত্য যে, তাফসীরের ক্ষেত্রে
ইবনু জারীর, ইবনু আবি হাতিম ও
ইবনু আতীয়া গারনাতী প্রমুখ পূর্বসূরীদের ভাষ্যের তিনি মাঝে মাঝে অনুসরণ করেছেন।
কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি আবার কোন এক বিশেষ উক্তিকে অন্য উক্তির উপর প্রাধান্য
দিয়েছেন, আয়াতের সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলোকে বর্ণনা করতে গিয়ে কোনটি অপ্রামাণ্য সে কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। আর এভাবে
রাবী বা বর্ণনাকারীদের সূক্ষ্ম সমালোচনা করতে তিনি আদৌ পশ্চাদপদ হননি।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা
যেতে পারে যে, ‘সূরাতুল বাকারা’র ১৮৫ আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে তিনি আবূ নুজাইহ বিন
আবদুর রহমান আলমাদানী এবং আবু হাতিম প্রমুখ বর্ণনাকারীদেরকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত
করেন।১ অনুরূপভাবে উক্ত সূরাতুল বাকারার ৬৭ আয়াত : إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن
تَذْبَحُوا بَقَرَةً الى اخر الاية তাফসীর করতে গিয়ে
প্রথমে গাভী সম্পর্কিত প্রচলিত চিত্তাকর্ষক কাহিনী আগাগোড়া তিনি বর্ণনা করেছেন। এ
প্রসঙ্গে সালফে সালেহীনের উক্তি এবং ‘উবাইদাহ’ আবুল আলীয়াহ ও
সুদ্দী প্রমুখের বর্ণনা সম্পর্কেও ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তারপর সমগ্ৰ কাহিনীটিকে
তিনি অনির্ভরযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।২ উক্ত ‘সুরাতুল বাকারা’র ২৫১ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তিনি ইয়াহিয়া বিন সাঈদ প্রমুখ রাবীদেরও
দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন।৩
পবিত্র কুরআনের ২৬ পারায় ‘সূরায়ে কাফ' এর সূচনায় ق নামক যে আদ্য অক্ষরটি রয়েছে সে সম্পর্কে অন্যান্য
মুফাসসির বা ভাষ্যকার বলেন যে, এটি সারা বিশ্বজাহানকে পরিবেষ্টনকারী এক পাহাড়ের (কোকাফ) নাম। হাফিয ইমাদদ্দীন
ইবন কাসীর এ প্রসঙ্গে বলেন যে, এ ধরনের ইসরাঈলী রেওয়ায়িত কোনক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।”৪
কুরআন মাজীদের অন্যান্য
আয়াত ও হাদীস শরীফ ছাড়া তিনি স্বীয় তাফসীরের কোন কোন স্থানে ফেকাহ শাস্ত্রীয়
বিতর্কের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করার শ্রম স্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আহকাম
সম্বন্ধীয় আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন মাযহাবের আলিমদের উক্তি ও
দলীলসমূহের উল্লেখ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, সূরাতুল বাকারার
১৮৫ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট চারটি মাসয়ালার কথা উল্লেখ করেন। এ
সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন মাযহাবের আলেমদের উক্তি, দলীল প্রমাণ এবং অভিমতও পেশ করেন।৫ অনুরূপভাবে
সূরাতুল বাকারার তালাক সম্বন্ধীয় ২৩০ আয়াতের৬ তাফসীর করতে গিয়েও পুনর্বিবাহের শর্তসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি অনুকূল প্রতিকূল সমস্ত দলীল প্রমাণের কথা উল্লেখ করেন।৭ এভাবে আহকাম সম্বন্ধীয় আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে
--
১. 'তাফসীর ইবনু কাসীর’ঃ ১ম খণ্ডঃ পৃঃ ২১৬।
২. ‘আত্তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরূন' ১ম খণ্ড
(পূর্বোক্ত) পৃঃ ২৪৫-২৪৬।
৩. ‘তাফসীর ইবনু কাসীর’ ১ম খণ্ডঃ (পূর্বোক্ত) পৃঃ ৩০৩, ১০৮-১১০,
৪. ‘তাফসীর ইবনু কাসীর’, ৪র্থ খণ্ড
(পূর্বোক্ত) পৃঃ ২২১,
৫. ‘তাফসীর ইবনু কাসীর’ঃ ১ম খণ্ড (পূর্বোক্ত) পৃঃ ২১৬-২১৭।
৬. আলোচ্য আয়াতটি
নিম্নরূপঃ
فَإِن طَلَّقَهَا
فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ - الى الاخر (২ঃ২৩০)
৭. তাফসীর ইবনু কাসীরঃ ১ম
খঃ (পূর্বোক্ত) পৃঃ ২৭৭-২৭৯।
--
হাফিয ইবনু কাসীর ফেকাহ
শাস্ত্রবিদদের তুমুল বিতর্ক ও বাদানুবাদের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে তাদের বিভিন্ন
মাযহাব ও দলীলসমূহকে নিয়ে আলোচনা করেছেন বটে, কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি কোথাও সীমালংঘন করেননি-যেভাবে অন্যান্য
ফেকাহশাস্ত্রজ্ঞ তাফসীরকারগণ সীমা-পরিসীমার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন।
হাফিয ইবনু কাসীর এই আলোচ্য
তাফসীরের শুরুতে প্রায় ১০ পৃষ্ঠা ব্যাপী এক গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ ‘মুকাদ্দিমা' বা ভূমিকার অবতারণা
করেছেন। এতে তাফসীর সম্বন্ধীয় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও
পর্যালোচনা করেছেন। এই তথ্যসমৃদ্ধ মূল্যবান ভূমিকার ফলে তাঁর তাফসীরের গুরুত্ব ও
মর্যাদা অনেকখানি বৰ্দ্ধিত হয়েছে। অবশ্য এই দীর্ঘ ভূমিকায় তিনি তার শ্রদ্ধেয়
শিক্ষক শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়ারও কিছু কিছু অনুসরণ করেছেন।১
এই অতি গুরুত্বপূর্ণ
তাফসীর ইবনু কাসীরের নির্ভরযোগ্যতা ও অপূর্ব জনপ্রিয়তাকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন
ভাষাভাষী পণ্ডিতবর্গ শুধু যে নানা ভাষায় এর অনুবাদ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন তাই নয়, বরং অনেকেই এর
সংক্ষিপ্ত সংস্করণ তৈরী করে প্রকাশ করতেও সচেষ্ট হয়েছেন। এই
সংক্ষেপকারীদের মধ্যে শায়খ মুহাম্মদ আলী আসাবুনীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তার এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটি
বইরুতের দারুল কুরআনিল কারীম নামক প্রকাশনী থেকে বেশ সুন্দর আকর্ষণীয়ভাবে তিন
খণ্ডে ছাপানো হয়েছে। নীচে টীকা-প্রটীকা বিশিষ্ট এই সংস্করণটি সর্বত্রই এতদূর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন যে, এ পর্যন্ত প্রায়
৮/৯টি সংস্করণ বেরিয়ে গেছে।
--
১. ‘মুকাদ্দিমা-ই-তাফসীর ইবনু কাসীরঃ (পূর্বোক্ত) পৃঃ ১-৯; ডঃ মুহাঃ হুসাইন
যাহাবীঃ ‘আত্তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরূন’ ১ম খন্ড
(পূর্বোক্ত) পৃঃ ২৪৪; মওলানা আবদুস সামাদ
সারিস আযহারীঃ ‘তারীখুল কুরআন ওয়াত তাফসীরঃ’ লাহোর ২য় সংস্করণ।
২. ‘সাফওয়াতুত্তাফাসীর’ ও ‘মুখতাসার ইবনু
কাসীর' নামক গ্রন্থদ্বয়ের
সংকলয়িতা শায়খ মুহাম্মদ আলী আসাবুনীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নরূপঃ
তিনি ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে
সিরিয়ার অন্তর্গত আলেপ্পো শহরে আশ্শাহবা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আলেপ্পোর আশ্শারয়িয়া মহাবিদ্যালয় হতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তারপর ১৯৫২
খৃষ্টাব্দে কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ
করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হিসেবে ১৯৫৪
খ্রীষ্টাব্দে মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি আলেপ্পোর বিভিন্ন
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আট বছরকাল শিক্ষকতা করেন। তারপর মক্কা মুকাররমায় ইসলাম ধর্ম
ও প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে বেশ কিছু দিন শিক্ষকতা করেন। এমনিভাবে তিনি সৌদী আরবে
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পঁচিশটি বছর অতিবাহিত করেন।
তাঁর রচনাবলীঃ কুরআন সুন্নাহর উপর তিনি যে সমস্ত মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলোর নাম
নিম্নে প্রদত্ত হলঃ
১। ‘রাওয়াইউল বায়ান ফী তাফসীরি আয়াতিল আহকামিল কুরআন’ (২ খণ্ড)। ২। ‘মিন কুনুযিস
সুন্নাহ’; দিরাসাতুন
আদাবিয়াতুল লুগাভিতুন লিল আহাদিসি।
৩। আল-মাওয়ারিস ফিস্ শারিয়াতিল ইসলামিয়া ফী যাউয়িল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ।
৪। আন্ নুবুওয়াত ওয়াল আম্বিয়া ওয়া দিরাসাতুন তাহলীলিয়াতুন লি হায়াতির রুসুলিল কিরাম।
৫। মুখতাসারু তাফসীর ইবনু
কাসীর (তিন খণ্ডে সমাপ্ত)
৬। আত্তিবয়ান ফী উলূমিল কুরআন।
৭। সুফুওয়াতুত তাফাসীর (তিন খণ্ডে সমাপ্ত)(বাকী-৩২ পৃঃ)
৮। মুখতাসারু তাফসীরিত তাবারী।
৯। তাহকীকু কিতাবি ফাতহির
রাহমান ফিমা ইয়ালতাবিসু মিনহু আয়াতুল কুরআন।
১০। তাহকীকু তাফসীরিদ
দাওয়াত আল-মুবারাকাত।
১১। রিসারাতুল মাহদী ওয়া
আশরাতুস সায়াত।
১২। রিসারাতু শুবহাত ওয়া আবাতিল হাওলা তা'আদ্দুদি যাওজাতির রুসুল (সঃ)। ১৩। আল হাদিউন নবভী আস সাহীহ ফী সালাতিত্ তারাবীহ।
১৪। আল মুন্তাখাবুল
মুখতার মিন কিতাবিল আযকার লিল ইমাম নবভী (রহ)।
এগুলো ছাড়াও তাঁর বহু
রচনাবলী পাণ্ডুলিপির আকারে আবদ্ধ ও প্রকাশনার পথে রয়েছে।
তিনি মক্কা মুকাররমার ‘উম্মুল কুরা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত স্থায়ী শিক্ষক। কিন্তু এতবড় আলেম, লেখক, সংকলক এবং বিদগ্ধ
মনীষী হওয়া সত্ত্বেও অতি দুঃখের সাথে জানাতে হয় যে, তাঁর আকীদা ও
ঈমানগত ত্রুটি বিচ্যুতি এবং আপত্তিজনক কার্যকলাপের জন্য আজ তিনি পবিত্র মক্কা শরীফ
এবং আরব দেশের অন্যত্রও অতি ব্যাপকভাবে নিন্দিত, বিতর্কিত এবং অতি বিরূপভাবে সমালোচিত। সউদী আরবের অন্ধ অথচ শ্রেষ্ঠতম আলেম
শায়খ আবদুল্লাহ বিন বায স্বয়ং তার বিরূপ সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। অনাগত দিনে
আমরা এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা পোষণ করি ।
--
ডঃ মুহাম্মদ মুজীবুর
রহমান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment