(করুণাময়, কৃপানিধান আল্লাহর নামে শুরু
করছি)
১। বলঃ আমি শরণ নিচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের,
২। যিনি মানবমণ্ডলীর রাজা বা অধিপতি;
৩। যিনি মানবমণ্ডলীর উপাস্য; কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে,
৫। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে,
৬। জ্বিনের মধ্য হতে অথবা মানুষের মধ্য হতে।
এ সূরায়
মহা মহিমান্বিত আল্লাহর তিনটি গুণ বিবৃত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি হলেন পালনকর্তা, শাহানশাহ এবং মাবুদ
বা পূজনীয়। সব কিছু তিনিই
সৃষ্টি করেছেন, সবই তার
মালিকানাধীন এবং সবাই তার আনুগত্য করছে। তিনি তার প্রিয় নবী (ﷺ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ হে নবী (ﷺ)!
তুমি বলে দাও, আমি আশ্রয়
প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির এবং মানুষের
মা'বুদের,
পশ্চাদপসরণকারীর অনিষ্ট হতে যে মানুষের অন্তরসমূহে কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা
দিয়ে থাকে। চাই সে জ্বিন হোক অথবা
মানুষ হোক। অর্থাৎ যারা অন্যায় ও খারাপ কাজকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে চোখের
সামনে হাজির করে পথভ্রষ্ট এবং বিভ্রান্ত করার কাজে যারা অতুলনীয়। আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই শুধু তাদের অনিষ্ট হতে রক্ষা পেতে পারে।
সহীহ হাদীসে
রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমাদের প্রত্যেকের সাথে একজন
করে শয়তান রয়েছে।”
সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহ্র
রাসূল (ﷺ)!
আপনার সাথেও কি শয়তান রয়েছে?” উত্তরে
তিনি বললেনঃ “হ্যা আমার
সঙ্গেও শয়তান রয়েছে? কিন্তু আল্লাহ তা'আলা ঐ শয়তানের মুকাবিলায় আমাকে সাহায্য করেছেন, কাজেই
আমি নিরাপদ থাকি। সে আমাকে পুণ্য ও কল্যাণের
শিক্ষা দেয়।”
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে
হযরত আনাস (رضي
الله عنه) হতে
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর ই'তেকাফে থাকা অবস্থায়
উম্মুল মু'মিনীন হযরত সফিয়া
(رضي الله عنه) তার সাথে রাতের বেলায় দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে যাবার সময় রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)ও তাঁকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে তার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকেন। পথে দু’জন আনসারীর
সাথে দেখা হলো। তারা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাথে তাঁর স্ত্রীকে দেখে দ্রুতগতিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে থামালেন এবং বললেনঃ “জেনে রেখো
যে, আমার সাথে
যে মহিলাটি রয়েছে এটা আমার স্ত্রী সফিয়া বিনতে হুইয়াই (رضي
الله عنه)।” তখন আনসারী
দু’জন বললেনঃ “আল্লাহ পবিত্র। হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)। এ কথা আমাদেরকে
বলার। প্রয়োজনই বা কি ছিল?” রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) উত্তরে বললেনঃ “মানুষের রক্ত প্রবাহের
স্থানে শয়তান ঘোরাফেরা করে থাকে। সুতরাং আমি আশংকা করছিলাম যে, শয়তান তোমাদের মনে সন্দেহ
সৃষ্টি করে দেয় না কি।”
হযরত আনাস ইবনে মালিক (رضي
الله عنه) হতে
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন “শয়তান তার হাত
মানুষের অন্তকরণের উপর স্থাপন করে রেখেছে। মানুষ যখন আল্লাহর ইবাদত করে তখন সে নিজের হাত মানুষের
অন্তকরণ থেকে সরিয়ে নেয়। আর যখন মানুষ
আল্লাহকে ভুলে যায় তখন শয়তান মানুষের অন্তকরণের উপর পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এটাই শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা এবং এটাই
ওয়াসওয়াসাতুল খান্নাস।”১
মুসনাদে আহমাদে এমন একজন সাহাবী হতে বর্ণিত আছে যিনি গাধার পিঠে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিছনে উপবিষ্ট ছিলেন। গাধা একটু হোঁচট খেলে ঐ সাহাবী বলে ওঠেনঃ “শয়তান ধ্বংস হোক।” তাঁর এ
কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ “এভাবে বলো না, এতে শয়তান আরো বড় হয়ে যায়, আরো এগিয়ে
আসে এবং বলেঃ আমি নিজের শক্তি দ্বারা তাকে কাবু করেছি। আর যদি বিসমিল্লাহ
বলো তবে সে ছোট হতে
হতে মাছির মতে হয়ে যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্র স্মরণে শয়তান পরাজিত ও নিস্তেজ
হয়ে যায়। আর আল্লাহকে বিস্মরণ হলে সে
বড় হয়ে যায় ও জয়যুক্ত হয়।
হযরত আবু হুরাইরা (رضي
الله عنه) হতে
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে কেউ মসজিদে
প্রবেশ করলে শয়তান তার কাছে যায় এবং আদর করে তার গায়ে হাত বুলাতে থাকে, যেমন মানুষ
গৃহপালিত পশুকে আদর করে। ঐ আদরে লোকটি
চুপ করে থাকলে শয়তান তার নাকে দড়ি বা মুখে লাগাম
পরিয়ে দেয়।”
হযরত আবু হুরাইরা (رضي
الله عنه) এ
হাদীসটি বর্ণনা করে বলেনঃ “তোমরা স্বয়ং নাকে দড়ি
লাগানো এবং মুখে লাগাম পরিহিত লোককে দেখতে পাও। নাকে দড়ি লাগানো হলো ঐ ব্যক্তি যে এক
দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে না। আর মুখে লাগাম
পরিহিত হলো ঐ ব্যক্তি যে মুখ
খুলে রাখে এবং আল্লাহর যিক্র করে না।”
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي
الله عنه) এ
আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, শয়তান আদম সন্তানের
মনে তার থাবা বসিয়ে রাখে। মানুষ যেখানেই ভুল করে এবং উদাসীনতার পরিচয় দেয় সেখানেই সে কুমন্ত্রণা দিতে শুরু
করে। আর যেখানে মানুষ আল্লাহূকে স্মরণ করে সেখানে
সে পশ্চাদপসরণ করে।
অন্য বর্ণনায় আছে যে, সুখ-শান্তি এবং দুঃখ কষ্টের সময় শয়তান মানুষের মনে ছিদ্র করতে চায়। অর্থাৎ তাকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা
করে। এ সময়ে যদি সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ করে তবে শয়তান পালিয়ে যায়।
হযরত
ইবনে আব্বাস (رضي
الله عنه) হতে
বর্ণিত আছে যে, শয়তানকে মানুষ যেখানে প্রশ্রয় দেয় সেখানে
সে মানুষকে অন্যায় অপকর্ম শিক্ষা দেয়, তারপর কেটে পড়ে।
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
মানব মণ্ডলীর অন্তর সমূহে কুমন্ত্রণা দেয়। (ناس)(নাস) শব্দের অর্থ মানুষ।
তবে এর অর্থ জ্বিনও
হতে পারে। কুরআন কারীমের অন্যত্র রয়েছেঃ (برجال من ا لجن) অর্থাৎ জ্বিনের মধ্য হতে কতকগুলো লোক। কাজেই জ্বিনসমূহকে (ناس) (নাস) শব্দের অন্তর্ভুক্ত করা অসঙ্গত
নয়। মোটকথা, শয়তান জ্বিন এবং মানুষের
মনে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে।
مِنَ
الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ (জ্বিনের মধ্য হতে
অথবা মানুষের মধ্য হতে)। অর্থাৎ
এরা কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে, চাই সে
জ্বিন হোক অথবা মানুষ হোক। এর তাফসীর এরূপও করা হয়েছে।
মানব ও দানব শয়তানরা
মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা অন্য
এক জায়গায় বলেনঃ
دوا شياطين الإنس والجن يوحى
بعضهم إلى
وكذلك جعلنا كل نبي
را ت اقول بعض
অর্থাৎ “এভাবেই
আমি মানবরূপী অথবা দানবরূপী শয়তানকে প্রত্যেক নবীর শত্রু বানিয়েছি। একজন অন্যজনের কানে থােকা-প্রতারণামূলক কথা সাজিয়ে
গুছিয়ে ব্যক্ত করে।”
(৬ ও ১১২)
মুসনাদে আহমদে হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) হতে
বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট হাজির হন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ
(ﷺ) মসজিদে অবস্থান করছিলেন। হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) তার
পাশে বসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আবু
যার (رضي
الله عنه)! তুমি
নামায পড়েছো কি?” তিনি উত্তরে
বললেনঃ “জ্বী,
না।”
তখন তিনি বললেনঃ “তা হলে
উঠে নামায পড়ে নাও।”
হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) উঠে
নামায পড়লেন। তারপর বসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেনঃ “হে আবু
যার (رضي
الله عنه) মানবরূপী
শয়তান হতে এবং দানবরূপী শয়তান হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর।”
হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)!
মানুষের মধ্যেও কি শয়তান আছে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ “হ্যা”, হযরত আবু
যার (رضي
الله عنه) জিজ্ঞেস
করলেনঃ “হে আল্লাহর
রাসূল (ﷺ) নামায কি?" তিনি জবাবে বললেনঃ “নামায খুব ভাল
কাজ। যার ইচ্ছা কম পড়তে পারে এবং
যার ইচ্ছা বেশী পড়তে পারে।”
হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) জিজ্ঞেস
করলেনঃ “হে আল্লাহর
রাসূল (ﷺ)। রোযা কি?" তিনি জবাব দিলেনঃ “যথেষ্ট হওয়ার মত একটি
ফরজ কাজ। আল্লাহর কাছে এর জন্যে বহু পুরস্কার
রয়েছে। হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) প্রশ্ন
করলেনঃ “সাদকা কি?”
তিনি উত্তরে বললেনঃ “সাদকা এমনই জিনিষ
যার বিনিময় বহুগুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে।”
হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) আর
করলেনঃ “হে আল্লাহর
রাসূল (ﷺ) কোন সাদকা সবচেয়ে উত্তম?" রাসূলুল্লাহ। (ﷺ) উত্তর দিলেনঃ “সম্পদ কম থাকা
সত্ত্বেও সাদকা করা, অথবা চুপে
চুপে কোন ফকীর মিসকীন ও দুঃখী জনের সাথে
উত্তম ব্যবহার করা। হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) জিজ্ঞেস
করলেনঃ “হে আল্লাহর
রাসূল (ﷺ)!
সর্বপ্রথম নবী কে ছিলেন?”
তিনি জবাবে বললেনঃ “হযরত আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম নবী।” হযরত আবু
যার (رضي
الله عنه) জিজ্ঞেস
করলেনঃ “হযরত আদম (আঃ) কি নবী ছিলেন?”
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জবাব দিলেনঃ “হ্যা,
তিনি নবী ছিলেন, এবং এমন
ব্যক্তি ছিলেন যার সঙ্গে আল্লাহ তা'আলা কথাবার্তা
বলেছেন। হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) প্রশ্ন
করলেনঃ “হে আল্লাহর
রাসূল (ﷺ)। রাসূল কত জন ছিলেন?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “তিনশত দশের কিছু
বেশী, বলা যায়
একটি বড় জামাআত।”
আবার এও বললেনঃ “তিনশত
পনেরো।”
হযরত আবু যার (رضي
الله عنه) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)!
আপনার প্রতি নাযিলকৃত আয়াতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আয়াত কোনটি?” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জবাব দিলেনঃ “আয়াতুল কুরসী অর্থাৎ (اللّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ) এই আয়াতটি।”২
মুসনাদে আহমদে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي
الله عنه) হতে
বর্ণিত আছে যে, একটি লোক
নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে বললোঃ “হে আল্লাহর
রাসূল (ﷺ)!
আমার মনে এমন সব চিন্তা আসে যেগুলো
প্রকাশ করার চেয়ে আকাশ থেকে পড়ে যাওয়াই আমার নিকট বেশী পছন্দনীয় (সুতরাং এ অবস্থায়
আমি কি করবো?)। নবী (ﷺ) উত্তরে বললেনঃ “(তুমি বলবে)ঃ
الله اكبر الله أكبر الحمد لله الذي رد كيده إلى الوسوسة .
অর্থাৎ “আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান আল্লাহ
তা'আলার জন্যেই
সমস্ত প্রশংসা যিনি শয়তানের প্রতারণাকে ওয়াসওয়াসা অর্থাৎ শুধু কুমন্ত্রণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন, বাস্তবে কার্যে পরিণত করেননি।”
(সূরা ফালাক ও নাস এর তাফসীর সমাপ্ত)
==============
ফুটনোটসঃ
ফুটনোটসঃ
১. এ হাদীসটি হাফিয আবুইয়ালা মুসিলী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটি গারীব বা দুর্বল।
২. এ হাদীসটি ইমাম নাসায়ীও (রঃ) বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া ইমাম আবু হাতিম ইবনে হিব্বানও (রঃ) অন্য সনদে এ হাদীসটি দীর্ঘভাবে বর্ণনা করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
২. এ হাদীসটি ইমাম নাসায়ীও (রঃ) বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া ইমাম আবু হাতিম ইবনে হিব্বানও (রঃ) অন্য সনদে এ হাদীসটি দীর্ঘভাবে বর্ণনা করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
No comments:
Post a Comment