হযরত ইকরামা (রঃ) হতে
বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত ইসমাঈল
ইবনে কুসতুনতীন (রঃ) এবং হযরত শবল ইবনে ইবাদের (রঃ) সামনে কুরআন পাঠ করছিলেন। যখন
তিনি (وَالضُّحَى) , পর্যন্ত পৌঁছেন তখন তারা উভয়েই বলেনঃ এখান হতে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক সূরার
শেষে তাকবীর পাঠ করবেন। আমরা ইবনে কাসীর (রঃ)এর সামনে পাঠ করছিলাম, তিনি মুজাহিদ
(রঃ)-এর সামনে পাঠ করলে তিনিও তাঁকে এই নির্দেশ দেন। তিনি আমাদেরকে অনুরূপ কথা
বলেছিলেন। তিনি পাঠ করেছিলেন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর সামনে। তিনিও তাঁকে এই
হুকুম করেছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) পাঠ করেছিলেন হযরত উবাই ইবনে কা'বের (রাঃ) সামনে। তিনিও
তাঁকে এটারই আদেশ করেছিলেন। আর হযরত উবাই (রাঃ) পাঠ করেছিলেন রাসুলুল্লাহর সামনে
এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে এরই নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ইমামুল কিরআত হযরত আবু
হাসানও (রঃ) এই সুন্নাতের বর্ণনাকারী । হযরত আবূ হাতিম রাযী (রঃ) এ হাদীসকে দুর্বল
বলেছেন। কারণ আবুল হাসান বর্ণনাকারী হিসেবে দুর্বল। আবু হাতিম (রঃ) তাঁর নিকট হতে
কোন হাদীসই নিতেন না। অনুরূপভাবে হযরত আবু জাফর উকাইলীও (রঃ) তাঁকে মুনকারুল হাদীস
বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শায়েখ শিহাবুদ্দীন আবু শামাহ (রঃ) শারহি শা’তিবিয়্যায় হযরত ইমাম
শাফিয়ী (রঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি একজন লোককে নামাযের মধ্যে এ তাকবীর বলতে শুনে বলেনঃ “তুমি ভাল কাজই করেছো
এবং সুন্নাত পালন করেছে। এ ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, এ হাদীস সহীহ বা বিশুদ্ধ। এখন এ তাকবীর কোথায় ও কিভাবে পাঠ করতে হবে এ
ব্যাপারে কারীদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, (وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى) - এই সূরা সমাপ্ত হওয়ার পর হতে এ তাকবীর পাঠ করতে হবে। অন্যেরা বলেছেন, (وَالضُّحَى) এই সূরা সমাপ্ত হওয়ার পর হতে পড়তে হবে। আর কারো কারো মতে এটা পাঠের নিয়ম এই যে, শুধু আল্লাহু আকবার
বলতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেন যে,
(الله اكبر لا اله الا الله والله اكبر ) বলতে হবে।
কোন কোন কারী সূরা আদ্দোহা
হতে এই তাকবীর পাঠ করার কারণ এই বলে উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ)
নিকট অহী আসা কিছু দিনের জন্যে বন্ধ ছিল। তারপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এই সূরা নিয়ে
আসার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আনন্দের আতিশয্যে তাকবীর পাঠ করেন। কিন্তু এই বর্ণনা এমন
কোন সনদের সাথে বর্ণিত হয়নি যেটা দ্বারা এটাকে বিশুদ্ধ অথবা দুর্বল বলা যেতে পারে। এ সব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।
--
করুণাময়, কৃপানিধান আল্লাহর
নামে শুরু করছি।
১। শপথ পূর্বাহ্বের,
২। শপথ রজনীর যখন ওটা সমাচ্ছন্ন করে ফেলে;
৩। তোমার প্রতিপালক তোমাকে পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি বিরূপও হননি।
৪। তোমার জন্যে পরবর্তী
সময় তো পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা শ্রেয় বা কল্যাণকর।
৫। অচিরেই তোমার
প্রতিপালক তোমাকে এরূপ দান করবেন যাতে তুমি সন্তুষ্ট হবে।
৬। তিনি কি তোমাকে
পিতৃহীন অবস্থায় পাননি, অতঃপর তোমাকে আশ্রয়দান করেন নি?
৭। তিনি তোমাকে পেলেন পথ
সম্পর্কে অনবহিত, অতঃপর তিনি পথের নির্দেশ দিলেন।
৮। তিনি তোমাকে পেলেন
নিঃস্ব অবস্থায়, অতঃপর অভাবমুক্ত করলেন;
০৯। অতএব, তুমি পিতৃহীনের
প্রতি কঠোর হয়ো না,
১০। আর প্রার্থীকে
ভর্ৎসনা করো না।
১১। তুমি তোমার
প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা
ব্যক্ত করতে থাকো।
--
হযরত জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত
আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, এ কারণে তিনি একদিন
বা দুদিন রাত্রে তাহাজ্জুদ নামাযের জন্যে উঠতে পারেননি। এটা জেনে একটি মহিলা এসে
বলেঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! তোমাকে
তোমার শয়তান পরিত্যাগ করেছে।”,তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ
(وَالضُّحَى
وَاللَّيْلِ
إِذَا سَجَى
مَا
وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَى)
এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন।১
হযরত জুনদুব (রাঃ) বলেন
যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ)
নিকট হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর আসতে কয়েকদিন বিলম্ব হয়েছিল, এতে মুশরিকরা
বলাবলি করতে শুরু করে যে, মুহাম্মদ(সঃ)কে তার
প্রতিপালক পরিত্যাগ করেছেন, তখন আল্লাহ তা'আলা উপরোক্ত আয়াতগুলো
অবতীর্ণ করেন।
অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর আঙ্গুলে পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তা থেকে রক্ত
প্রবাহিত হলে তিনি বলেনঃ
هل انت
الا إصبع دیت * وفي سبيل الله مالقيت
অর্থাৎ “তুমি শুধু একটি
আঙ্গুল বৈ তো নও, আর আল্লাহর পথে তোমার
এ যখম হয়েছে।” শারীরিক অসুস্থতা
বশতঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) দুই তিন দিন উঠতে পারেননি, এতেই ঐ মহিলাটি উপরোক্ত অশালীন উক্তি করেছিল। অতঃপর উপরোক্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ
হয়। জানা যায় যে, ঐ দুষ্টা মহিলাটি
ছিল আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল । তার প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত নাযিল হোক।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আঙ্গুল আহত হওয়া এবং তাতে উপরোক্ত পংক্তি আকস্মিকভাবে তার মুখে উচ্চারিত হওয়ার কথা তো সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে
রয়েছে, কিন্তু তাহাজ্জুদ
আদায়ে অসমর্থতা যে সেই কারণে হয়েছিল এবং এই আয়াতগুলো যে ঐ উপলক্ষ্যে অবতীর্ণ
হয়েছিল এ উক্তি উসূলে হাদীসের পরিভাষায় গারীব বলে উল্লিখিত হয়েছে।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)
বর্ণনা করেছেন যে, হযরত খাদীজা (রাঃ)
রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে বলেনঃ “আপনার প্রতিপালক
আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট তো হননি?” তখন এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত জিবরাঈল
(আঃ)-এর আসতে বিলম্ব হওয়ায় রাসূলুল্লাহ শংকিত হয়ে পড়েন। এ কারণে হযরত খাদীজা
(রাঃ) উপরোক্ত মন্তব্য করেন। তখন এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। এ দুটি বর্ণনাকে উসূলে
হাদীসের পরিভাষায় মুরসাল বলা হয়েছে। তবে খাদীজা (রাঃ)-এর নাম ও উক্তি উল্লেখ এ
ক্ষেত্রে সমীচীন মনে হয় না। হ্যা, তবে হয় তো দুঃখ ও বেদনার বশবর্তী হয়েই তিনি এ ধরনের উক্তি করে থাকবেন। এটা
অসম্ভব নয়। তবে এ সব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।
ইবনে ইসহাক (রঃ) এবং
পূর্ব যুগীয় কোন কোন গুরুজন বলেছেন যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) যে সময় তার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এবং খুবই কাছাকাছি
হয়েছিলেন সে সময় এই ধরনের অহী অবতীর্ণ হয়েছিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, অহী বন্ধ হয়ে
যাওয়ার প্রেক্ষিতে মুশরিকদের অবাঞ্ছিত উক্তির অসারতা প্রমাণের জন্যেই এ আয়াতসমূহ
অবতীর্ণ হয়। এখানে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা রোদ্র ওঠার সময়ের দিনের আলো, রাত্রির নীরবতা এবং অন্ধকারের শপথ করেছেন। এগুলো মহান স্রষ্টার কুদরতের এবং
সৃষ্টির ঐশ্বর্যের সুস্পষ্ট প্রমাণ। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
والليل
إذا يغشی - والنهار إذا تجلى
অর্থাৎ “শপথ রজনীর যখন ওটা
আচ্ছন্ন করে এবং শপথ দিবসের যখন ওটা আবির্ভূত হয়।” (সূরাঃ লাইল/৯২, আয়াতঃ ১-২)
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (হে নবী (সঃ)! তোমার প্রতিপালক তোমাকে
ছেড়েও দেননি। এবং তোমার সাথে শত্রুতাও করেননি। তোমার জন্যে পরকাল ইহকাল অপেক্ষা
বহুগুণে উত্তম। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ইবাদত করতেন এবং
দুনিয়া বিমুখ জীবন যাপন করতেন। নবী করীম (সঃ)-এর জীবনী যারা পাঠ করেছেন তাঁদের
কাছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন।
মুসনাদে আহমদে হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)
একটি খেজুর পাতার চাটাইর উপর শুয়েছিলেন। ফলে তাঁর দেহের পার্শ্বদেশে চাটাইর দাগ
পড়ে গিয়েছিল। তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর আমি তার দেহে হাত বুলিয়ে বললামঃ হে
আল্লাহর রাসূল (সঃ)! চাটাইর উপর আমাকে কিছু বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দিন! তিনি আমার
এ কথা শুনে বললেনঃ “পৃথিবীর সাথে আমার
কি সম্পর্ক? আমি কোথায় এবং
দুনিয়া কোথায়? আমার এবং দুনিয়ার
দৃষ্টান্ত তো সেই পথচারী পথিকের মত যে একটি গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ
করে, তারপর গন্তব্য
স্থলের উদ্দেশ্যে চলে যায়।” ২
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ তোমার
প্রতিপালক তোমাকে আখেরাতে তোমার উম্মতের জন্যে এতো নিয়ামত দিবেন যে, তুমি খুশী হয়ে
যাবে। তোমাকে বিশেষ সম্মান দান করা হবে। বিশেষভাবে হাউযে কাওসার দান করা হবে। সেই
হাউযে কাওসারের কিনারায় খাটি মুক্তার তাবু থাকবে। ওর মাটি হবে নির্ভেজাল মিশক। এ
সম্পর্কিত হাদীস অচিরেই বর্ণনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, যে সব ধনাগার
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উম্মতের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে সেগুলো একে একে তার উপর
প্রকাশ করা হয়। এতে তিনি খুবই খুশী হন। তারপর এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। জান্নাতে তাকে
এক হাজার মহল দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক মহলে পবিত্র স্ত্রী এবং উৎকৃষ্ট মানের খাদেম
রয়েছে।”৩
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ)
বলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সঃ) সন্তুষ্টির এটাও একটা কারণ যে, তাঁকে জানানো হয়ঃ
তার আহ্লে বাইতের মধ্য থেকে কেউ জাহান্নামে যাবে না। হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা তার শাফা'আত বুঝানো হয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ)
হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বলেছেনঃ “আমরা এমন আহলে
বায়েত যাদের জন্যে আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ার মুকাবিলায় আখেরাতকে পছন্দ করেছেন। তারপর তিনি (وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى) , পাঠ করেন।” ৪
অতঃপর আল্লাহ তাআলা
স্বীয় নিয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি ইয়াতীম
থাকা অবস্থায় আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করেছেন, হিফাযত করেছেন, প্রতিপালন করেছেন
এবং আশ্রয় দিয়েছেন। নবী করিম (সঃ)-এর জন্ম লাভের পূর্বেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল
করেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন যে, তাঁর জন্ম লাভের পর তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। ছয় বছর বয়সের সময় তার
স্নেহময়ী মাতা এই নশ্বর জগত হতে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। তারপর তিনি তার দাদা আবদুল
মুত্তালিবের আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন। তার বয়স যখন আট বছর তার দাদাও পরপারে চলে
যান। অতঃপর তিনি তার চাচা আবু তালিবের নিকট প্রতিপালিত হতে থাকেন। আবু তালিব তাকে
সর্বাত্মক দেখাশুনা এবং সাহায্য করেন। তিনি তাঁর স্নেহের ভ্রাতুস্পুত্রকে খুবই
সম্মান করতেন, মর্যাদা দিতেন এবং
স্বজাতির বিরোধিতার ঝড়ে মুকাবিলা করতেন। নিজেকে তিনি ঢাল হিসেবে উপস্থাপন করতেন। চল্লিশ
বছর বয়সের সময় নবী করীম (সঃ) নবুওয়াত লাভ করেন। কুরায়েশরা তখন তার ভীষণ বিরোধী
এমনকি প্রাণের দুশমন হয়ে গেল। আবু তালিব মুশরিক মূর্তিপূজক হওয়া সত্ত্বেও
রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে সহায়তা দান করতেন এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের সাথে লড়াই করতেন।
এই সুব্যবস্থা আল্লাহপাকের ইচ্ছা ও ইঙ্গিতেই হয়েছিল। নবী করীম (সঃ)-এর ইয়াতীমী
অবস্থা এভাবেই কেটে যায়। আল্লাহ তাআলা বিরুদ্ধবাদীদের নিকট হতে এভাবেই নবী করীমের
(সঃ)-এর খিদমত নেন। হিজরতের কিছুদিনের পূর্বে আবু তালিবও ইন্তেকাল করেন। এবার
কাফির মুশরিকরা কঠিনভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। আল্লাহ তাআলা তখন রাসূলুল্লাহ
(সঃ)কে মদীনায় হিজরত করার অনুমতি দেন এবং মদীনার আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়কে তার
সাহায্যকারী বানিয়ে দেন। ঐ বুর্যগ আনসার ব্যক্তিবর্গ রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে এবং তাঁর
সাহাবীদেরকে(রাঃ)আশ্রয় দিয়েছেন, জায়গা দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন এবং
তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। আর শত্রুদের মুকাবিলায় বীরের মত সামনে অগ্রসর
হয়ে যুদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তাদের সবারই প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন! এ সবই আল্লাহর
মেহেরবানী, অনুগ্রহ এবং রহম
করমের ফলেই সম্ভব হয়েছিল।
এরপর মহান আল্লাহ স্বীয়
নবী (সঃ)কে বলেনঃ তোমাকে আল্লাহ তা'আলা পথহারা দেখতে পেয়ে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ
وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِّنْ
أَمْرِنَا مَا كُنتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَكِن
جَعَلْنَاهُ نُورًا نَّهْدِي بِهِ مَنْ نَّشَاء مِنْ عِبَادِنَا
অর্থাৎ “এ ভাবেই আমি নিজের
আদেশে তোমার প্রতি রুহ্ অর্থাৎ জিবরাইল (আঃ)কে অথবা কুরআনকে অহী হিসেবে পাঠিয়েছি।
ঈমান কি জিনিস তাও তোমার জানা ছিল না, কিতাব কাকে বলে তাও জানতে না তুমি। আমি এ কিতাবকে নুর বা জ্যোতি বানিয়ে এর
দ্বারা আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেছি।” (৪২ ঃ ৫২)
কেউ কেউ বলেন, এখানে ভাবার্থ হলো
এই যে, নবী করীম (সঃ)
শৈশবে মক্কার গলিতে হারিয়ে গিয়েছিলেন। ঐ সময় আল্লাহ তা'আলা তাঁকে যথাস্থানে
ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আবার এটাও বলা হয়েছে যে, তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়া যাওয়ার পতে রাত্রিকালে শয়তান তাঁর
উটের লাগাম ধরে চলার পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। তারপর জিবরাঈল
(আঃ) এসে শয়তানকে কুঁদিয়ে আবিসিনিয়ায় রেখে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)
সওয়ারীকে সঠিক পথে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।”৫
আল্লাহ তা'আলা এরপর বলেনঃ হে নবী
(সঃ)! তিনি (আল্লাহ) তোমাকে পেলেন নিঃস্ব অবস্থায়, অতঃপর তিনি তোমাকে অভাবমুক্ত করলেন ফলে ধৈর্যধারণকারী দরিদ্র এবং কৃতজ্ঞতা
প্রকাশকারী ধনীর মর্যাদা তুমি লাভ করেছো। আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রতি
দুরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন!
কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এসব অবস্থা নবুওয়াতের
পূর্বে হয়েছিল। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত
আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বলেছেন “ধন সম্পদের
প্রাচুর্য প্রকৃত ধনশীলতা নয়, বরং প্রকৃত ধনশীলতা হচ্ছে মনের ধনশীলতা বা মনের সন্তুষ্টি।”
সহীহ মুসলিমে হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, আল্লাহ যা কিছু
দিয়েছেন তা যথেষ্ট মনে করেছে এবং তাতেই সন্তুষ্ট হয়েছে সে সাফল্য লাভ করেছে।"
এরপর মহান আল্লাহ স্বীয়
নবী (সঃ)কে সম্বোধন করে বলেনঃ সুতরাং তুমি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হয়ো না, তাকে ধমক দিয়ো না
এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার করো না, বরং তার সাথে সদ্ব্যবহার কর এবং নিজের ইয়াতীম হওয়ার কথা ভুলে যেয়ো না।
কাতাদা (রঃ) বলেন যে, ইয়াতীমের সাথে ঠিক
এমনই ব্যবহার করতে হবে। যেমন ব্যবহার পিতা নিজের সন্তানের সাথে করে থাকেন।
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)কে আরো
বলেনঃ প্রার্থীকে
না করো না। তুমি যেমন
পথহারা ছিলে, আল্লাহ তোমাকে
হিদায়াত বা পথের দিশা দিয়েছেন, তেমনি কেউ তোমাকে জ্ঞানের কথা জিজ্ঞেস করলে তাকে রূঢ় ব্যবহার দ্বারা সরিয়ে
দিয়ো না। গরীব, মিসকীন, এবং দুর্বল লোকদের
প্রতি অহংকার প্রদর্শন করো না। তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করো না। তাদেরকে কড়া কথা বলো
না। ইয়াতীম মিসকীনদেরকে যদি কিছু না দিতে পার তবে ভাল ও নরম কথা বলে তাদেরকে বিদায়
করো এবং ভালভাবে তাদের প্রশ্নের জবাব দাও।
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ
নিজের প্রতিপালকের নিয়ামতসমূহ বর্ণনা করতে থাকো। অর্থাৎ যেমন আমি তোমার দারিদ্রকে
ঐশ্বর্যে পরিবর্তিত করেছি, তেমনই তুমিও আমার এ
সব নিয়ামতের কথা বর্ণনা করতে থাকো। যেমন নবী করীম (সঃ)এর দু'আও ছিলঃ
واجعلنا شاكرين لنعمتك مثنين بها عليك قابليها
واتها علينا .
অর্থাৎ “হে আল্লাহ!
আমাদেরকে আপনি আপনার নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী করুন, ঐ নিয়ামতের কারণে
আমাদেরকে আপনার প্রশংসাকারী করুন, ঐ নিয়ামত স্বীকারকারী করুন এবং পরিপূর্ণভাবে ঐ নিয়ামত আমাদেরকে দান করুন।”
আবু নাযরা (রঃ) বলেনঃ “মুসলমানরা মনে
করতেন যে, নিয়ামতের বর্ণনা
দেয়াও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার শামিল।৬
হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে বলেনঃ “যে ব্যক্তি অল্প পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। সে বেশী পেয়েও কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ করে না। যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো না সে আল্লাহ তা'আলার প্রতিও কৃতজ্ঞতা
জ্ঞাপন করলো না। নিয়ামত স্বীকার ও বর্ণনা করাও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শামিল, আর নিয়ামত
অস্বীকার করা অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক। দলবদ্ধভাবে থাকা রহমত লাভের কারণ এবং দল থেকে
বিচ্ছিন্ন হওয়া শাস্তির কারণ।”৭
সহীহ বুখারী ও সহীহ
মুসলিমে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মুহাজিরগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল
(সঃ)! আনসারগণ সমস্ত প্রতিদান
নিয়ে গেছেন।” তখন রাসূলুল্লাহ
(সঃ) তাদেরকে বললেনঃ “না, যে পর্যন্ত তোমরা
তাদের জন্যে দু’আ করতে থাকবে এবং
তাদের প্রশংসা করতে থাকবে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ)
হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ)
বলেছেনঃ “যারা মানুষের প্রতি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না তারা আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।”৮
হযরত জাবির (রাঃহতে
বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কোন
নিয়ামত লাভ করার পর তার বর্ণনা করেছে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী, আর যে তা গোপন
করেছে সে অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে।” ৯
হযরত জাবির ইবনে
আবদিল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ “কাউকে কোন অনুগ্রহ
করা হলে তার উচিত সম্ভব হলে ঐ অনুগ্রহের প্রতিদান দেয়া, আর যদি সম্ভব না
হয় তবে উচিত অন্ততঃপক্ষে ঐ অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করা এবং তার প্রশংসা করা। যে
ব্যক্তি এই প্রশংসা করেছে সে কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। আর যে ব্যক্তি প্রশংসাও
করেনি এবং নিয়ামতের কথা প্রকাশও করেনি সে অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে।"১০
কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, এখানে নিয়ামত
দ্বারা নবুওয়াতকে বুঝানো হয়েছে। এক বর্ণনায় রয়েছে যে, এখানে নিয়ামত
দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুরআন।
হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলো
কল্যাণকর যে সব কথা নিজে জান, সে সব তাদের কাছেও বর্ণনা কর। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ
নবুওয়াতের যে নিয়ামত ও কারামত তুমি লাভ করেছে সেটা বর্ণনা কর। ঐ কথা আলোচনা কর।
আর সেইদিকে জনগণকে দাওয়াত দাও।
কাজেই নবী করীম (সঃ)
নিজের লোকদের কাছে অর্থাৎ যাদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল তাদের কাছে প্রথমদিকে চুপি
চুপি দাওয়াত দিতে শুরু করেন। তাঁর উপর নামায ফরয হয়েছিল, তিনি সেই নামায
আদায় করতেন।
--
(সূরাঃ দুহা এর তাফসীর সমাপ্ত)
--
❏ টীকাঃ
১. এ হাদীসটি ইমাম
আহমদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ, ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)
বর্ণনা করেছেন।
২. এ হাদীসটি জামে তিরযিমীতেও বর্ণিত হয়েছে এবং উসূলে হাদীসের পরিভাষায়
হাদীসটি হাসান।
৩. এ হাদীসটি ইবনে আমর আওযায়ী (রঃ) ইবনে জারীর (রঃ) এবং ইবনে আবী হাতিম (রঃ)বর্ণনা
করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) পর্যন্ত এ হাদীসের সনদ
বিশুদ্ধ। আল্লাহর নবী (সঃ) হতে না শুনে এ ধরনের হাদীস বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
৪. এ হাদীসটি ইবনে আবী শায়বা (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৫. এই উভয় উক্তিই বাগাভী (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৬. এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৭. এহাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর সনদে দুর্বলতা রয়েছে।
৮. এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৯. এ হাদীসটিও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
১০. এ হাদীসটিও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
allahu akbar
ReplyDelete