সূরাঃ ফালাক/১১৩, মাক্কী (আয়াতঃ ৫, রুকূ : ১)


সূরাঃ ফালাক ও নাস।

আশ্রয় প্রার্থনা করার দুইটি সূরা

হযরত যার ইবনে জায়েশ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত উবাই ইবনে কা'ব (رضي الله عنه)কে বলেনঃহযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এ সূরা দুটিকে (সূরা ফালাক ও সূরা নাসকে) কুরআনের অন্তর্ভুক্ত বলেন না।তখন হযরত উবাই ইবনে কা'ব (رضي الله عنه) বলেনঃআমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ () আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে বলেনঃ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) বলুন।তিনি তা বললেন। তারপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে বললেনঃআপনি (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) বলুন।তিনি তা বললেন। সুতরাং আমরা ওটাই বলি যা নবী করীম () বলেছেন।

মুসনাদে আবী ইয়ালা প্রভৃতি কিতাবে উল্লিখিত আছে যে, হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এ দুটি সূরাকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত বলে লিখেননি। এবং এগুলোকে কুরআনের অংশ বলে মনে করতেন না। কারী এবং ফকীহদের নিকট প্রসিদ্ধ উক্তি এই যে, হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এদুটি সূরাকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে লিখতেন না। সম্ভবতঃ তিনি নবী করীম ()-এর কাছে শুনেননি। তারপর হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) তাঁর কথা থেকে ফিরে জামাআতের মতামতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। সাহাবায়ে কিরাম এ দুটি সূরাকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যার নুসখাহ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

সহীহ্ মুসলিমে হযরত উকবা ইবনে আমির (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ () বলেছেন, “তোমরা কি দেখোনি যে, ঐ রাত্রে আমার উপর এমন কতকগুলো আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যেমন আয়াত আর কখনো অবতীর্ণ হয়নি।তারপর তিনি এ সূরা দু'টি তিলাওয়াত করেন।

মুসনাদে আহমদে হযরত উকবাহ ইবনে আমির (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃআমি মদীনার গলি পথে রাসূলুল্লাহ ()-এর সাথে তাঁর উটের লাগাম ধরে যাচ্ছিলাম, এমন সময় তিনি আমাকে বললেনঃএসো এবার তুমি আরোহণ করোআমি চিন্তা করলাম যে, তাঁর কথা না শোনা অবাধ্যতা হবে, তাই আরোহণ করতে সম্মত হলাম। কিছুক্ষণ পর আমি নেমে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ () আরোহণ করলেন। তারপর তিনি বললেনঃ " হে উকবাহ (رضي الله عنه)আমি কি তোমাকে দু'টি উৎকৃষ্ট সূরা শিখিয়ে দিবো না?” আমি আর করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল () হ্যা, অবশ্যই আমাকে শিখিয়ে দিন! তখন তিনি আমাকে (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ)এবং (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) পাঠ করালেন। অতঃপর উট হতে নেমে রাসূলুল্লাহ () নামায পড়ালেন এবং নামাযে এ সূরা দু'টি পাঠ করলেন তারপর তিনি আমাকে বললেন! হে উকবাহ (رضي الله عنه)! আমি সূরা দুটি পাঠ করেছি তা তুমি লক্ষ্য করেছো তো? শোনো, ঘুমোবার সময় এবং দাঁড়ানোর সময় এ সূরা দু'টি পাঠ করবে।

মুসনাদে আহমদের অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ () হযরত উকবাহ ইবনে আমিরকে (رضي الله عنه) প্রত্যেক নামাযের শেষে এ দু'টি সূরা তিলাওয়াত করার নির্দেশ দিয়েছেন।

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেনঃহে উকবাহ্ (رضي الله عنه) তুমি আশ্রয় প্রার্থনা করার এ সূরা দুটি পাঠ করো, কেননা এ দু'টি সূরার মত সূরা তুমি কখনো পড়বেই না” | হযরত উকবাহ্ ইবনে আমির (رضي الله عنه) সম্পর্কিত হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর উটের উপর তিনি আরোহণ করেছিলেন। ঐ হাদীসের কোন কোন বর্ণনায় এও রয়েছে যে, হযরত উকবাহ (رضي الله عنه) বলেনঃরাসূলুল্লাহ () সূরা দু'টি আমার কাছে তিলাওয়াত করার পর আমাকে তেমন আনন্দিত হতে না দেখে বলেনঃসম্ভবতঃ তুমি এ সূরা দু'টিকে খুব সাধারন সূরা মনে করেছে । জেনে রেখো যে, নামাযে পড়ার ক্ষেত্রে এ সূরা দুটির মত কিরআত আর নেই।

সুনানে নাসাঈতে রয়েছে যে, এ দু'টি সূরার মত সূরা কোন আশ্রয় প্রার্থীর জন্যে আর নেই।



অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ () হযরত উকবাহ্র (رضي الله عنه) দ্বারা এ সূরা দুটি পাঠ করিয়ে নেয়ার পর বললেন, আশ্রয় প্রার্থনার মত সূরা এ দু'টি সুরার মত আর নেই।"

এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ () এ সূরা দু'টি ফজরের নামাযে পাঠ করেন।

অন্য একটি হাদীসে আছে যে, হযরত উকবাহ ইবনে আমির (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ ()-এর বাহনের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন এবং তাঁর পায়ে হাত রেখে বলছিলেনঃহে আল্লাহর রাসূল ()! সূরা হূদ অথবা সূরা ইউনুস শিখিয়ে দিন।রাসূলুল্লাহ () তখন বললেনঃসূরা ফালাক অপেক্ষা অধিক উপকার দানকারী কোন সূরা আর নেই।

আর একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ () তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)কে বলেনঃ আমি আপনাদেরকে জানাচ্ছি যে, আশ্রয়প্রার্থীদের জন্যে এ দু'টি সূরার চেয়ে উত্তম আর কোন সূরা নেই।

অন্য এক হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ () এ দু'টি সূরা এবং সূরা ইখলাস সম্পর্কে বলেছেনঃচারটি আসমানী কিতাবে এ তিনটির মত সূরা আর একটিও অবতীর্ণ হয়নি।

মুসনাদে আহমদে হযরত আলা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক বলেনঃ আমরা এক সফরে রাসূলুল্লাহ ()-এর সাথে ছিলাম। সওয়ারীর সংখ্যা ছিল কম, তাই পালাক্রমে আমরা আরোহণ করছিলাম। রাসূলুল্লাহ ()একজন সাহাবীর মাথায় হাত রেখে তাকে একটি সূরা পড়ালেন এবং বললেনঃনামায পড়ার সময় এ সূরা দুটি (সূরা ফালাক ও সূরা নাস) পাঠ করবে।সম্ভবতঃ ঐ সাহাবীর নাম উকবাহ ইবনে আ'মিরই (رضي الله عنه) হবে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

হযরত আবদুল্লাহ আসলামী ইবনে আনীস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ () তার বুকে হাত দিয়ে বললেনঃবলো" হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) কি বলবেন তা বুঝতে পারলেন না। রাসূলুল্লাহ () পুনরায় বললেন।বলোহযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) তখন (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ)বললেন। রাসূলুল্লাহ () আবার বললেনঃবলোহযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه)
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ
مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
বললেন। রাসূলুল্লাহ () পুনরায় বললেনঃবলো হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) তখন (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) বললেন। রাসূলুল্লাহ () বললেনঃএভাবেই আশ্রয় প্রার্থনা করবে। আশ্রয় প্রার্থনা করার মত এ রকম সূরা আর নেই।
সুনানে নাসায়ীর অন্য একটি হাদীসে রয়েছে যে, হযরত জাবির (رضي الله عنه)-এর নিকট রাসূলুল্লাহ () এ সূরা দুটি পাঠ শুনলেন। তারপর বললেন এগুলো পড়তে থাকবে। পড়ার মত এ রকম সূরা আর পাবে না।

উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত একটি হাদীস পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () রাত্রিকালে যখন বিছানায় যেতেন তখন তিনি সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে হাতের উভয় তালুতে ফু দিয়ে সারা দেহের যতোটুকু উভয় হাতের নাগালে পাওয়া যায় ততোটুকু পর্যন্ত হাতের ছোয়া দিতেন। প্রথমে মাথায়, তারপর মুখে এবং এরপর দেহের সামনের অংশে তিনবার এভাবে হাত ফিরাতেন।

ইমাম মালিক (رضي الله عنه)-এরমুআত্তাগ্রন্থে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () যখন। অসুস্থ হতেন তখন এ দুটি সূরা পাঠ করে তিনি সারা দেহে ফুঁ দিতেন। রাসূলুল্লাহর () অসুস্থতা যখন মারাত্মক হয়ে যেতো তখন হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) আউযুবিল্লাহ পাঠ করে রাসূলুল্লাহ ()-এর হস্তদ্বয় তাঁরই সারা দেহে ফিরাতেন। হযরত আয়েশা (رضي الله عنه)-এর এরূপ করার কারণ ছিল রাসূলুল্লাহ ()-এর পবিত্র ও বরকতময় হাতের স্পর্শ তারই দেহে পৌঁছিয়ে দেয়া। | এক হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () জ্বিন এবং মানুষের কু-দৃষ্টি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। এ দু'টি সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি এ সূরা দু'টিকে গ্রহণ করেন এবং বাকি সব ছেড়ে দেন।

(করুণাময়, কৃপানিধান আল্লাহর নামে শুরু করছি)।
১। বলঃ আমি শরণ নিচ্ছি ঊষার স্রষ্টার।
২। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে,
৩। অনিষ্ট হতে রাত্রির যখন ওটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়;
৪। এবং ঐ সব নারীর অনিষ্ট হতে যারা গ্রন্থিতে ফুৎকার দেয়।
৫। এবং অনিষ্ট হতে হিংসুকের, যখন সে হিংসা করে।

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত জাবির (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, (فلق) সকাল বেলাকে বলা হয়। আওফী (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতেও এটাই বর্ণনা করেছেন। কুরআন কারীমেরই অন্য জায়গায় (فالق الاصباح) রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, (فلق)এর অর্থ হলো মাখলুক। হযরত কা'ব আহরার (رضي الله عنه) বলেন যে, (فلق) হলো জাহান্নামের একটি জায়গা। ঐ জায়গার দরজা খোলা হলে তথাকার আগুনের উত্তাপ এবং ভয়াবহতায় জাহান্নামের সমস্ত অধিবাসী চীৎকার করতে শুরু করে। একটি মারফু হাদীসেও উপরোক্ত হাদীসেরই প্রায় অনুরূপ উক্তি রয়েছে। কিন্তু ওটাকে মুনকার হাদীস বলা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, (فلق) জাহান্নামের নাম। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, প্রথমটিই সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য উক্তি। অর্থাৎ (فلق) এর অর্থ হলো সকাল বেলা । ইমাম বুখারীও (রঃ) একথাই বলেছেন। এবং এটাই নির্ভুল।

সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর অপকারিতার মধ্যে জাহান্নাম, ইবলীস ও ইবলীসের সন্তান সন্ততিও রয়েছে। (غَاسِقٍ) এর অর্থ হলো রাত।, (إِذَا وَقَبَ) এর অর্থ হলো সূর্যাস্ত।

অর্থাৎ যখন অন্ধকার রাত উপস্থিত হয়। ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, আরবের লোকেরা সুরাইয়া নক্ষত্রের অস্তমিত হওয়াকে (غَاسِقٍ) বলে। অসুখ এবং বিপদ আপদ সুরাইয়া নক্ষত্র উদিত হওয়ার পর বৃদ্ধি পায় এবং ঐ নক্ষত্র অস্তমিত হওয়ার পর অসুখ বিপদ আপদ কেটে যায়।

একটি মারফু হাদীসে রয়েছে যে, (غَاسِقٍ) হলো নক্ষত্রের নাম। কিন্তু এ হাদীসের মারফু হওয়ার কথা সত্য নয়। কোন কোন তাফসীরকার বলেন যে, (غَاسِقٍ) এর অর্থ হলো চাঁদ। তাফসীরকারদের দলীল হলো মুসনাদে আহমদে বর্ণিত একটি হাদীস, যাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () হযরত আয়েশা (رضي الله عنه)-এর হাত ধরে চাঁদের প্রতি ইশারা করে বললেনঃআল্লাহর কাছে ঐ (غَاسِقٍ) এর অপকারিতা হতে আশ্রয় প্রার্থনা কর।

অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, (غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ) দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে। উভয় উক্তির মধ্যে সহজেই সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে বলা যেতে পারে যে, এটা হলো চাঁদের ক্রমবৃদ্ধি এবং নক্ষত্ররাজির আত্মপ্রকাশ ইত্যাদি। এসব কিছু রাত্রিকালেই হয়ে থাকে এবং যখন রাত্রির আগমন ঘটে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

গ্রন্থিসমূহের উপর পড়ে পড়ে ফুৎকারকারিণীরা অর্থাৎ যাদুকর নারীগণ। | হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, যেই মন্ত্র পাঠ করে সাপে কাটা রোগীর উপর ফু দেয়া হয় এবং ভূত প্রেত তাড়ানোর জন্যে ফু দেয়া হয় এগুলো শিরকের খুবই কাছাকাছি। অন্য হাদীসে রয়েছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ()-এর কাছে এসে বললেনঃহে মুহাম্মদ () আপনি কি রোগাক্রান্ত?” রাসূলুল্লাহ () উত্তরে বললেনহ্যাহযরত জিবরাঈল (আঃ) তখন নিম্নের দু'আ দু'টি পাঠ করেনঃ

بسم الله أرقيك من كل داء يؤذيك ومن شر كل حاسد وعين الله يشفيك

অর্থাৎআল্লাহর নামে আমি আপনাকে ফু দিচ্ছি সেই সব রোগের জন্যে যা আপনাকে কষ্ট দেয়, প্রত্যেক হিংসুকের অনিষ্ট ও কুদৃষ্টি হতে আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন।এই রোগ দ্বারা সম্ভবতঃ ঐ রোগকেই বুঝানো হয়েছে যে রোগে তিনি যাদুকৃত হওয়ার পর আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা স্বীয় রাসূল ()কে সুস্থতা ও আরোগ্য দান করেন। এতে হিংসুটে ইয়াহূদীদের যাদুর প্রভাব নস্যাৎ হয়ে যায়। তাদের সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়া হয়। তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। রাসূলুল্লাহ ()কে যাদু করা সত্ত্বেও তিনি যাদুকারীদেরকে কোন কটু কথা বলেননি এবং ধমকও দেননি। আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী ()কে সুস্থতা ও আরোগ্য দান করেন।

মুসনাদে আহমদে হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী () এর উপর একজন ইয়াহূদী যাদু করেছিল। এই কারণে নবী () কয়েকদিন পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। তারপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে তাঁকে জানান যে, অমুক ইয়াহূদী তার উপর যাদু করেছে এবং অমুক অমুক কুঁয়ায় গ্রন্থি বেঁধে রেখেছে। সুতরাং তিনি যেন কাউকে পাঠিয়ে ঐ গ্রন্থি খুলিয়ে আনেন। রাসূলুল্লাহ () তোক পাঠিয়ে তখন কুঁয়া থেকে ঐ যাদু বের করিয়ে আনান এবং গ্রন্থিখুলে ফেলেন। ফলে যাদুর প্রভাব কেটে যেতে শুরু করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ () ঐ ইয়াহূদীকে এ সম্পর্কে একটি কথাও বলেননিএবং তাকে দেখে কখনো মুখও মলিন করেননি।

সহীহ বুখারীতে কিতাবুত তিব্বে হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর উপর যাদু করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ ভেবেছিলেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে গিয়েছেন, অথচ তিনি তাঁদের কাছে যাননি। হযরত সুফইয়ান (রঃ) বলেন যে, এটাই যাদুর সবচেয়ে বড় প্রভাব। এ অবস্থা হওয়ার পর একদিন রাসূলুল্লাহ () বললেনঃহে আয়েশা (رضي الله عنه)! আমি আমার প্রতিপালককে জিজ্ঞেস করেছি এবং তিনি আমাকে জানিয়েছেন। দুজন লোক আমার কাছে আসেন। একজন আমার মাথার কাছে এবং অন্যজন আমার পায়ের কাছে বসেন 'আমার কাছে অর্থাৎ শিয়রে যিনি বসেছিলেন, তিনি দ্বিতীয়জনকে জিজ্ঞেস করলেনঃএর অবস্থা কি?” দ্বিতীয়জন উত্তরে বললেনঃএর উপর যাদু করা হয়েছে। প্রথম জন প্রশ্ন করলেনঃকে যাদু করেছো" দ্বিতীয়জন জবাব দিলেনঃলুবাইদ ইবনে আসাম। সে বান্ যুরাইক গোত্রের লোক। সে ইয়াহূদীদের মিত্র এবং মুনাফিক।প্রথম জন জিজ্ঞেস করলেনঃকিসের মধ্যে যাদু করেছো?" দ্বিতীয়জন উত্তর দিলেনঃমাথার চুলে ও চিরুণীতে। প্রথমজন প্রশ্ন করলেনঃকোথায়, তা দেখাও।দ্বিতীয়জন উত্তর দিলেনঃখেজুর গাছের বাকলে, পাথরের নিচে এবং যারওয়ান কূপে।অতঃপর রাসূলুল্লাহ () ঐ কূপের কাছে গমন করলেন এবং তা থেকে ওসব বের করলেন। ঐ কূপের পানি ছিল যেন মেহদীর রঙ। ওর পাশের খেজুর গাছগুলোকে ঠিক শয়তানের মাথার মত মনে হচ্ছিল। হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল ()ঃ এ কাজের জন্যে তার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা উচিত। রাসূলুল্লাহ() একথা শুনে বললেনঃসমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। তিনি আমাকে নিরাময় করেছেন ও সুস্থতা দিয়েছেন। আমি মানুষের মধ্যে মন্দ ছড়ানো পছন্দ করি না।

অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ () কোন একটা কাজ করেননি। অথচ তাঁর মনে হতো যে, তিনি ওটা করেছেন। এটাও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহর () নির্দেশক্রমে ঐ কূপে মাটি ভর্তি করে দেয়া হয়। এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ছয় মাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহর () এরূপ অবস্থা ছিল।

তাফসীরে সা'লাবীতে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, ইয়াহুদীদের একটা ছেলে রাসূলুল্লাহ ()-এর খিদমত করতোঐ ছেলেটিকে ফুসলিয়ে ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহর () কয়েকটি চুল এবং তাঁর চুল আঁচড়াবার চিরুনীর কয়েকটি দাঁত হস্তগত করে। তারপর তারা ওগুলোতে যাদু করে। এ কাজে সবচেয়ে বেশী সচেষ্ট ছিল লুবাইদ ইবনে আসাম। এরপর যাদুর গ্রন্থি বা যুরাইক যারওয়ান নামক কূপে স্থাপন করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ () অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর স্ত্রীদের কাছে গমন না করেও তার মনে হতো যে তিনি তাঁদের কাছে গমন করেছেন। এইমন ভুলো অবস্থা দূরীকরণের জন্যে রাসূলুল্লাহ () সচেষ্ট ছিলেন, কিন্তু এরকম অবস্থা হওয়ার কারণ তাঁর জানা ছিল না। ছয় মাস পর্যন্ত ঐ একই অবস্থা চলতে থাকে। তারপর উপরোল্লিখিত ঘটনা ঘটে। দুজন ফেরেশতা এসে কথোপকথনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ()কে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করেন। রাসূলুল্লাহ () তখন হযরত আলী (رضي الله عنه), হযরত যুবায়ের (رضي الله عنه) এবং হযরত আম্মার (رضي الله عنه)কে পাঠিয়ে কূপ থেকে যাদুর গ্রন্থিগুলো বের করিয়ে আনেন। ঐ যাদুকৃত জিনিষগুলোর মধ্যে একটি ধনুকের রঞ্জু ছিল, তাতে ছিল বারোটি গ্রন্থি বা গেরোপ্রত্যেক গেরোতে একটি করে উঁচ বিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারপর আল্লাহ তা'আলা এ সূরা দুটি অবতীর্ণ করেন। রাসূলুল্লাহ () এ সূরা দু'টির এক একটি আয়াত পাঠ করছিলেন আর ঐ গ্রন্থিসমূহ একটি একটি করে আপনা আপনি খুলে যাচ্ছিল। সূরা দুটি পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত গেরোই খুলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ () সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এদিকে হযরত জিবরাঈল (আঃ) উপরোল্লিখিত দু'আ পাঠ করেন। সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ ()কে বলেনঃহে আল্লাহর রাসূল ()! আমরা কি ঐ নরাধমকে ধরে হত্যা করে ফেলবো না?” রাসূলুল্লাহ () উত্তরে বললেনঃনা, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি মানুষের মধ্যে অনিষ্ট ও বিবাদ ফাসাদ সৃষ্টি করতে চাই না।” ­


ফুটনোটসঃ

১. এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ রিওয়াইয়াত সহীহ বুখারীতেও বর্ণিত হয়েছে।
২. এহাদীসটি মুসনাদে আহমদে জামে তিরমিযী এবং সুনানে নাসায়ীতেও বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।
. জামে তিরমিযী, সুনানে আবী দাউদ এবং সুনানে নাসায়ীতেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
. এ হাদীসটিও সুনানে আবী দাউদ, জামে তিরমিযী এবং সুনানে নাসায়ীতে বর্ণিত আছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে গারীব বা দুর্বল বলেছেন।
. এ হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
. এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসায়ী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ)বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিজী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।
. এ বর্ণনায় গারাবাত ও নাকারাত রয়েছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।



No comments:

Post a Comment