সহীহ
মুসলিমে হযরত জাবির (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)
তাওয়াফের পর দুই রাকআত নামাযে এই সূরা এবং (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) সূরা
পাঠ করতেন। সহীহ মুসলিমেই হযরত আবু হুরাইরা (رضي
الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)
ফজরের দুই রাকআত সুন্নত নামাযেও এ সূরা দুটি পাঠ করতেন। মুসনাদে আহমদে হযরত ইবনে
উমার (رضي الله عنه)
হতে বর্ণিত আছে যে,
রাসূলুল্লাহ
(ﷺ)
ফজরের পূর্বের দুই রাকআতে এবং মাগিরিবের পরের দুই রাকআ’তে (قُلْ يَا أَيُّهَا
الْكَافِرُونَ) এবং (قُلْ هُوَ اللَّهُ
أَحَدٌ) এই সূরা দুইটি বিশেরও
অধিকবার অথবা দশেরও অধিকবার পাঠ করতেন।
মুসনাদে আহমদে হযরত ইবনে উমার (رضي الله عنه)
হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি ফজরের দুই রাকআত সুন্নাত নামাযে এবং মাগরিবের দুই
রাকআত সুন্নাত নামাযে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে (قُلْ يَا أَيُّهَا
الْكَافِرُونَ) এবং (قُلْ هُوَ اللَّهُ
أَحَدٌ) এই সূরা দুটি চব্বিশ বার
অথবা পঁচিশবার পড়তে দেখেছি।
মুসনাদে আহমদেরই অন্য এক
রিওয়াইয়াতে হযরত ইবনে উমার (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে এক মাস ধরে ফজরের পূর্বের দুই রাকআত নামাযে এবং মাগরিবের পরের
দুই রাকআতে নামাযের (قُلْ يَا أَيُّهَا
الْكَافِرُونَ) এবং (قُلْ هُوَ اللَّهُ
أَحَدٌ) এ
সূরা দু'টি পাঠ করতে দেখেছেন।১
এই সূরাটি যে কুরআনের এক
চতুর্থাংশের সমতুল্য এ বর্ণনাটি ইতিপূর্বে গত হয়েছে। (إِذَا زُلْزِلَتِ) সূরাটিও একই বৈশিষ্ট্য
সম্পন্ন।
মুসনাদে আহমদে হযরত নওফিল ইবনে
মুআবিয়া (رضي الله عنه)
হতে বর্ণিত,
তিনি
তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁকে (তাঁর পিতাকে) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)
বলেনঃ “যয়নব (رضي الله عنه)কে
তুমি তোমার কাছে নিয়ে প্রতিপালন কর।" নওফিলের (رضي الله عنه)
পিতা এক সময়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর
নিকট আগমন করলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “মেয়েটি সম্পর্কে তুমি কি করেছো?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “আমি তাকে তার মায়ের
কাছে রেখে এসেছি।”
রাসূলুল্লাহ
(ﷺ)
তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ
“কেন
রেখে এসেছো?”
তিনি
(নওফিল (رضي الله عنه)-এর
পিতা মুআবিয়া উত্তরে বললেনঃ “শয়নের পূর্বে পড়ার জন্যে আপনার কাছে কিছু ওয়াযীফা
শিখতে এসেছি।”
রাসূলুল্লাহ
তখন বললেনঃ (قُلْ يَا أَيُّهَا
الْكَافِرُونَ) পাঠ করো, এতে শিরক থেকে মুক্তি
লাভ করা যাবে।"
হযরত জিবিল্লাহ ইবনে হা'রিসাহ্ (رضي الله عنه)
হতে বর্ণিত আছে যে,
নবী
করীম (ﷺ)
বলেছেনঃ
“যখন
তুমি বিছানায় শয়ন করতে যাবে তখন (قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ) সূরাটি
শেষ পর্যন্ত পাঠ করবে। কেননা, এটা হলো শিরক হতে মুক্তি লাভের উপায়।”২
আবদুর রহমান (رضي الله عنه)
হতে বর্ণিত আছে যে,
রাসূলুল্লাহ
(ﷺ)
যখন বিছানায় শয়ন করতে যেতেন তখন (قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ) সূরাটি
শেষ পর্যন্ত পাঠ করতেন।৩
হযরত হারিস ইবনে জিবিল্লাহ (رضي الله عنه)
হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ
“আমি
বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দিন যা আমি ঘুমোবার সময় পাঠ করবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)
বললেনঃ “যখন তুমি বিছানায় ঘুমোতে
যাবে তখন (قُلْ يَا أَيُّهَا
الْكَافِرُونَ) পাঠ করবে। কেননা, এটা শিরক হতে মুক্তি
লাভের উপায়।৪ এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
করুণাময়, কৃপানিধান আল্লাহর নামে
শুরু করছি
১। বলঃ হে কাফিরগণ!
২। আমি তার ইবাদত করি না যার
ইবাদত তোমরা কর।
৩। এবং তোমরাও তার ইবাদতকারী নও যাঁর
ইবাদত আমি করি,
৪। এবং আমি ইবাদতকারী নই তার, যার ইবাদত তোমরা
করে আসছো।
৫। এবং তোমরা তাঁর ইবাদতকারী নও যাঁর
ইবাদত আমি করি।
৬। তোমাদের জন্য তোমাদের কর্মফল এবং আমার জন্যে আমার কর্মফল।
এই মুবারক সূরায় আল্লাহ তাআলা
মুশরিকদের আমলের প্রতি তাঁর অসন্তুষ্টির কথা ঘোষণা করেছেন এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁরই
ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে মক্কার কুরায়েশদেরকে সম্বোধন করা হলেও
পৃথিবীর সমস্ত কাফিরকে এই সম্বোধনের আওতায় আনা হয়েছে। এই সূরার শানে নুযূল এই যে, কাফিররা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে
বললোঃ “এক বছর আপনি আমাদের
মাবুদ প্রতিমাগুলোর ইবাদত করুন, পরবর্তী বছর আমরাও এক আল্লাহর ইবাদত করবো।" তাদের এই প্রস্তাবের
জবাবে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা এ সূরা নাযিল করেন।
আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (ﷺ)কে আদেশ
করছেনঃ তুমি বলে দাওঃ হে কাফিরগণ! না আমি তোমাদের উপাস্যদের উপাসনা করি, না তোমরা আমার মাবৃদের
উপাসনা কর। আর না আমি তোমাদের উপাস্যদেরকে উপাসনা করবো, না তোমরা আমার মাবুদের
উপাসনা করবে। অর্থাৎ আমি শুধু আমার মাবুদের পছন্দনীয় পদ্ধতি অনুযায়ী তাঁরই
উপাসনা করবো,
তোমাদের
পদ্ধতি তো তোমরা নির্ধারণ করে নিয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
إِن يَتَّبِعُونَ
إِلَّا الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الْأَنفُسُ وَلَقَدْ جَاءهُم مِّن رَّبِّهِمُ
الْهُدَى
অর্থাৎ “তারা শুধু মনগড়া
বিশ্বাস এবং খাহেশাতে নাফসানী বা কুপ্রবৃত্তির পিছনে পড়ে রয়েছে, অথচ তাদের কাছে তাদের
প্রতিপালকের হিদায়াত বা পথ নির্দেশ পৌছে গেছে।” (৫৩
ও ২৩) অতএব, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)
তাদের সংস্পর্শ হতে নিজেকে সর্বপ্রকারে মুক্ত করে নিয়েছেন এবং তাদের উপাসনা
পদ্ধতি ও উপাস্যদের প্রতি সর্বাত্মক অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। লক্ষ্যণীয় যে, প্রত্যেক ইবাদতকারীরই মাবুদ বা উপাস্য থাকবে এবং
উপাসনার পদ্ধতি থাকবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং
তাঁর উম্মত শুধু আল্লাহ তা'আলারই ইবাদত বা উপাসনা
করেন। নবী করীমের (ﷺ) অনুসারীরা তাঁরই শিক্ষা অনুযায়ী ইবাদত করে থাকে। এ কারণেই
ঈমানের মূলমন্ত্র হলোঃ
لآ اِلَهَ اِلّا اللّهُ
مُحَمَّدٌ رَسُوُل اللّهِ
অর্থাৎ
আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। এবং মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর
রাসূল।” পক্ষান্তরে কাফির
মুশরিকদের উপাস্য বা মাবুদ আল্লাহ ছাড়া ভিন্ন, তাদের
উপাসনার পদ্ধতিও ভিন্ন ধরনের। আল্লাহর নির্দেশিত পদ্ধতির সাথে তাদের কোনই সম্পর্ক
নেই। এজন্যেই আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (ﷺ)কে
নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি যেন কাফিরদেরকে
জানিয়ে দেনঃ তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন এবং আমার জন্যে আমার দ্বীন। যেমন আল্লাহ
তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ
وَإِن كَذَّبُوكَ فَقُل
لِّي عَمَلِي وَلَكُمْ عَمَلُكُمْ أَنتُمْ بَرِيئُونَ مِمَّا أَعْمَلُ وَأَنَاْ
بَرِيءٌ مِّمَّا تَعْمَلُونَ
অর্থাৎ “হে নবী (ﷺ)
যদি তারা তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তবে তাদেরকে বলে দাওঃ আমার আমল আমার জন্যে
এবং তোমাদের আমল তোমাদের জন্যে, আমি যে আমল করি তা হতে তোমরা
মুক্ত এবং তোমরা যে আমল কর তা হতে আমিও মুক্ত।” (১০ ঃ ৪১) আল্লাহ
তাবারাকা ওয়া তা'আলা আরো বলেনঃ
لَنَا أَعْمَالُنَا
وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ
অর্থাৎ “আমাদের
কর্ম আমাদের জন্যে এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্যে।" (৪২
ঃ ১৫) অর্থাৎ আমাদের কর্মের জন্যে তোমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না এবং তোমাদের
কর্মের জন্যে আমাদেরকেও জবাবদিহি করতে হবে না।
সহীহ
বুখারীতে এ আয়াতের তাফসীরে লিখা হয়েছেঃ তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন অর্থাৎ কুফর, আর আমার জন্যে আমার দ্বীন অর্থাৎ ইসলাম। আয়াতের শব্দ
হলো (ديني) কিন্তু অন্যান্য আয়াতে
যেহেতু (نون)এর
উপর ওয়াকফ হয়েছে সেই হেতু এখানেও (ى) কে উহ্য রাখা হয়েছে। যেমন (فهو يهدين) এবং (يسقين) এর মধ্যে (ى) কে উহ্য রাখা হয়েছে।
কোন কোন তাফসীরকারের মতে এ
আয়াতের অর্থ হলোঃ আমি তোমাদের বর্তমান উপাস্যদের উপাসনা করি না, ভবিষ্যতের জন্যেও তোমাদেরকে হতাশ করছি যে, সমগ্র জীবনে ঐ কুফরী আমার (নবী (ﷺ)-এর)
দ্বারা কখনো সম্ভব হবে না। একইভাবে তোমরা আমার প্রতিপালকের ইবাদত বর্তমানেও কর না
এবং ভবিষ্যতেও করবে না।
এখানে ঐ সব কাফিরকে বুঝানো
হয়েছে যাদের ঈমান আনয়ন না করার ব্যাপার আল্লাহ তা'আলার
জানা রয়েছে। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ
وَلَيَزِيدَنَّ
كَثِيراً مِّنْهُم مَّا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ طُغْيَانًا وَكُفْرًا-
অর্থাৎ “তোমার প্রতি যা কিছু অবতীর্ণ
করা হয় ঐ ব্যাপারে তাদের অধিকাংশ হঠকারিতা ও কুফরীতে লিপ্ত হয়।" (৫ ঃ ৬৮)
কোন কোন আরবী সাহিত্য বিশারদ
হতে ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) উদ্ধৃত করেছেন যে, একটি বাক্যকে দু’বার গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ পাক বলেনঃ
فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ
يُسْرًا- إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا
অর্থাৎ “কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি
আছে,
অবশ্য
কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।” আর এক জায়গায় বলেনঃ
لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ-
ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِينِ
অর্থাৎ “তোমরা তো জাহান্নাম
দেখবেই,
আবার
বলি তোমরা তো ওটা দেখবেই চাক্ষুষ প্রত্যক্ষে।”
আলোচ্য
সূরায় একই রকম বাক্য দু’বার ব্যবহারের তিনটি
কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমতঃ প্রথম বাক্যে উপাস্য এবং দ্বিতীয় বাক্যে ইবাদত
বা উপাসনার পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ প্রথম বাক্যে বর্তমান এবং দ্বিতীয়
বাক্যে ভবিষ্যৎ বুঝানো হয়েছে। তৃতীয়তঃ প্রথম বাক্যের তাগীদের জন্যেই দ্বিতীয়
বাক্যের অবতারণা করা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এখানে
চতুর্থ একটি কারণ আবূ আব্বাস ইবনে তাইমিয়া (রঃ) তাঁর কোন এক কিতাবে উল্লেখ
করেছেন। তিনি বলেনঃ আরবী ব্যাকরণের পরিভাষায় প্রথম বাক্য জুমলায়ে ফেলিয়া এবং
দ্বিতীয় বাক্য জুমলায়ে ইসমিয়া অর্থাৎ আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করি না, আমার নিকট হতে অনুরূপ কোন আশাও কেউ করতে পারে না। এ
উক্তিটিও ভালো বলেই মনে হয়। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
ইমাম
শাফিয়ী (রঃ) এ আয়াত থেকেই দলীল গ্রহণ করেছেন যে, কাফিররা
সবাই এক জাতি। এ কারণে ইয়াহূদীরা খৃস্টানদের এবং খৃস্টানরা ইয়াহুদীদের
উত্তরাধিকারী হতে পারে। উভয়ের মধ্যে বংশগত ও কার্যকরণ গত সামঞ্জস্য ও অংশীদারিত্ব
রয়েছে। এ কারণে ইসলাম ছাড়া কুফরীর যতগুলো পথ রয়েছে, বাতিল হিসেবে সবই এক ও অভিন্ন। ইমাম আহমদ (রঃ) এবং
তাঁর অনুসারীদের মাযহাব এর বিপরীত। তারা বলেন যে, ইয়াহুদীরা
খৃষ্টানদের বা খৃষ্টানরা ইয়াহুদীদের উত্তরাধিকারী হতে পারবে না, কেননা, হাদীসে
রয়েছে যে, দুটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী
একে অন্যের অংশীদার ও উত্তরাধিকারী হতে পারে না।
(সূরাঃ ‘কা-ফিরুন এর তাফসীর
সমাপ্ত)
===============
টীকাঃ
১. এ হাদীসটি জামে তিরমিযী, সুনানে ইবনে মাজাহ এবং সুনানে নাসায়ীতেও রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান বলেছেন।
১. এ হাদীসটি জামে তিরমিযী, সুনানে ইবনে মাজাহ এবং সুনানে নাসায়ীতেও রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান বলেছেন।
২. এ হাদীসটি ইমাম আবুল
কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৩. এ হাদীসটিও ইমাম
তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৪, এ
হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
No comments:
Post a Comment