হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)
বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি চায় যে, কিয়ামতকে যেন সে
স্বচক্ষে দেখছে সে যেন إِذَا
السَّمَاءُ انشَقَّتْ - إِذَا السَّمَاءُ انفَطَرَتْ - إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ (এই সূরাগুলো) পাঠ করে।”১
--
করুণাময়, কৃপানিধান আল্লাহর
নামে শুরু করছি
১। সূর্য যখন নিষ্প্রভ
হবে,
২। যখন নক্ষত্ররাজি খসে
পড়বে,
৩। পর্বতসমূহকে যখন চলমান করা হবে,
৪। যখন পূর্ণ-গর্ভা
উষ্ট্ৰী উপেক্ষিত হবে,
৫। যখন বন্য পশুগুলি
একত্ৰকৃত হবে;
৬। এবং সমুদ্রগুলিকে যখন উপপ্লাবিত-উদ্বেলিত করা হবে;
৭। দেহে যখন আত্মা পুনঃ সংযোজিত হবে,
৮। যখন জীবন্ত-প্রথিতা
কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে;
৯। কি অপরাধে তাকে হত্যা
করা হয়েছিল?
১০। যখন আমলনামা উন্মোচিত
হবে,
১১। যখন আকাশের আবরণ অপসারিত হবে,
১২। জাহান্নামের অগ্নি
যখন উদ্দীপিত করা হবে,
১৩। এবং জান্নাত যখন সমীপবর্তী করা হবে,
১৪। তখন প্রত্যেক
ব্যক্তিই জানবে সে কি নিয়ে এসেছে।
--
إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ -এ আয়াতের তাফসীরে হযরত
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ অর্থাৎ সূর্য আলোহীন হবে। আওফী (রঃ) বলেনঃ অর্থাৎ আলো চলে
যাবে। আরো অন্যান্য গুরুজন বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ সূর্যের আলো যেতে থাকবে এবং উপুড় করে মাটিতে নিক্ষেপ করা হবে ।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সূর্য, চন্দ্র এবং
নক্ষত্ররাজিকে একত্রিত করে নিষ্প্রভ করে দেয়া হবে, অতঃপর সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর উত্তপ্ত বাতাস প্রবাহিত হবে এবং আগুন
লেগে যাবে।
হযরত আবু মরিয়ম (রাঃ)
হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ সম্পর্কে বলেনঃ “সূর্যকে উপুড় করে
জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”২ অন্য একটি হাদীসে সূর্যের সাথে চাদেরও উল্লেখ
রয়েছে। কিন্তু ঐ হাদীসটি দুর্বল। সহীহ বুখারীতে শব্দের কিছু পরিবর্তনসহ এ হাদীসটি
বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সূর্য ও চন্দ্রকে জড়িয়ে নেয়া হবে। ইমাম বুখারী (রঃ) এ
হাদীসটি كتاب بدء الخلق -এর মধ্যে আনয়ন করেছেন।
কিন্তু এখানে উল্লেখ করাই ছিল বেশী যুক্তিযুক্ত। অথবা এখানে ওখানে উভয় স্থানে
আনয়ন করলেই তার অভ্যাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ)
যখন এ হাদীসটি বর্ণনা করেন যে, কিয়ামতের দিন এরূপ হবে তখন হযরত হাসান (রঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “ওদের অপরাধ কি?” তখন হযরত আবু
হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ আমি হাদীস বর্ণনা করছি আর তুমি এর মধ্যে কথা তুলছো? কিয়ামতের দিন
সূর্যের এ অবস্থা হবে, সমস্ত নক্ষত্র
বিকৃত হয়ে খসে পড়বে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انتَثَرَتْ
অর্থাৎ “যখন নক্ষত্রমণ্ডলী বিক্ষিপ্তভাবে ঝরে পড়বে।”
হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) বলেন যে, কিয়ামতের পূর্বে
ছয়টি নিদর্শন পরিলক্ষিত হবে। জনগণ বাজারে থাকবে এমতাবস্থায় হঠাৎ সূর্যের আলো
হারিয়ে যাবে। তারপর নক্ষত্ররাজি খসে খসে পড়তে থাকবে। এরপর অকস্মাৎ পর্বতরাজি
মাটিতে ঢলে পড়বে এবং যমীন ভীষণভাবে কাঁপতে শুরু করবে। মানব, দানব ও বন্য
জন্তুসমূহ সবাই পরস্পর মিলিত হয়ে যাবে। যেসব পশু মানুষকে দেখে ভয়ে পালিয়ে যেতো
তারা মানুষেরই কাছে নিরাপত্তার জন্যে ছুটে আসবে। মানুষ এমন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে
পড়বে যে, তারা তাদের প্রিয়
ও মূল্যবান গর্ভবতী উষ্ট্রীর খবর পর্যন্তও নেবে না। জ্বিনেরা বলবেঃ আমরা যাই, খবর নিয়ে আসি, দেখি কি হচ্ছে
কিন্তু তারা দেখবে যে, সমুদ্রেও আগুন লেগে
গেছে। ঐ অবস্থাতেই যমীন ফেটে যাবে এবং আকাশ ফাটতে শুরু করবে। সপ্ত যমীন ও সপ্ত
আকাশের একই অবস্থা হবে। একদিক থেকে গরম বাতাস প্রবাহিত হবে, যে বাতাসে সব
প্রাণী মারা যাবে।৩
হযরত ইয়াযীদ ইবনে আবী মরিয়ম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “নক্ষত্ররাজি এবং
আল্লাহ্ ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয়েছে তাদের সবাইকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা তবে, শুধু হযরত ঈসা (আঃ)
এবং তাঁর মাতা মরিয়ম (আঃ) বাকী থাকবেন। এঁরা যদি তাদের ইবাদতে খুশী হতেন তবে
এদেরকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হতো।”৪
পাহাড় নিজ জায়গা থেকে
বিচ্যুত হয়ে নাম নিশানাহীন হয়ে পড়বে। সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠ সমতল প্রান্তরে পরিণত হবে।
উট-উষ্ট্ৰীসমূহের প্রতি কেউ লক্ষ্য রাখবে না।অযত্নে অনাদরে ওগুলোকে ছেড়ে দেয়া হবে। কেউ ওগুলোর দুধও দোহন করবে না এবং ওগুলোকে
সওয়ারী হিসেবেও ব্যবহার করবে না।
عِشَارُ শব্দটি عشراء শব্দের বহুবচন। দশ মাসের গর্ভবতী উষ্টীকে عشراء বলা হয়। উদ্বেগ, ভয়-ভীতি, ত্রাস এবং
হতবুদ্ধিতা এতো বেশী হবে যে, ভাল ভাল মাল-ধনের প্রতিও কেউ ভ্রুক্ষেপ করবে না। কিয়ামতের সেই ভয়াবহতা
হৃদয়কে প্রকম্পিত করে দিবে। মানুষ এতদূর ভীত-বিহবল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও বিচলিত হয়ে পড়বে যে, তার কলিজা মুখের মধ্যে এসে পড়বে। কেউ কেউ বলেন যে, কিয়ামতের এই দিনে
এ অবস্থায় কারো কিছু বলার বা বলার মত অবস্থা থাকবে না। যদিও তারা সবই প্রত্যক্ষ করবে। এই উক্তিকারী عِشَارُ শব্দের কয়েকটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। একটি অর্থ হলো মেঘ, যা দুনিয়ার
ধ্বংসপ্রাপ্তির ফলে আসমান ও যমীনের মাঝে শূন্যে বিচরণ করবে। কারো কারো মতে এর
দ্বারা ঐ জমিনকে বুঝানো হয়েছে যার উশর দেয়া হয়। আবার অন্য কারো মতে এর দ্বারা ঐ
ঘর উদ্দেশ্য যা পূর্বে আবাদ ছিল, কিন্তু এখন বিরাণ হয়ে গেছে। এসব উক্তি উদ্ধৃত করে ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উষ্ট্রীকে বুঝানো হয়েছে এবং তিনি এই অর্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অধিকাংশ তাফসীরকারও
এটাকেই সমর্থন করেছেন। আমি বলি যে, পূর্বযুগীয় উলামায়ে কিরামের নিকট থেকে এ ছাড়া অন্য কোন অভিমত পাওয়া
যায়নি। আল্লাহ্ তা'আলাই এর সবচেয়ে
উত্তম তাৎপর্য সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত।
আল্লাহ্ তা'আলা আরও বলেনঃ এবং যখন
বন্য পশু একত্রিত করা হবে।' যেমন অন্যত্র
রয়েছেঃ
وَمَا مِن دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا طَائِرٍ
يَطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلَّا أُمَمٌ أَمْثَالُكُم ۚ مَّا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِن شَيْءٍ ۚ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّهِمْ يُحْشَرُونَ -
অর্থাৎ “ভূ-পৃষ্ঠে
বিচরণকারী সকল পশু এবং বাতাসে উড্ডয়নশীল সকল পাখীও তোমাদের মতই দলবদ্ধ। আমি আমার
কিতাবে সবকিছুর উল্লেখ করেছি, কোন কিছুই ছাড়িনি, অতঃপর তারা তাদের
প্রতিপালকের নিকট একত্রিত হবে।” (৬ : ৩৮)
সব কিছুর হাশর তারই নিকটে হবে, এমনকি মাছিরও। আল্লাহ্ তা'আলা সবারই সুবিচারপূর্ণ ফায়সালা করবেন। এসব প্রাণীর হাশর হলো তাদের মৃত্যু।
তবে দানব ও মানবের সকলকে আল্লাহ্ তা'আলার সামনে হাযির করা হবে এবং তাদের হিসাব-নিকাশ হবে। রাবী’ ইবনে হায়সাম (রঃ)
বলেন যে, বন্য জন্তুর হাশর
দ্বারা তাদের উপর আল্লাহর হুকুম হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস
(রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা তাদের
মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে। এসব প্রাণীও অন্যদের সাথে হাশরের মাঠে একত্রিত হবে। কুরআন
কারীমে রয়েছেঃ وَالطَّيْرَ
مَحْشُورَةً অর্থাৎ “পাখীদেরকে একত্রিত করা হবে।” (৩৮ঃ ১৯) এই আয়াতের প্রকৃত অর্থও হলো এই যে, বন্য জন্তুগুলোকে সমবেত বা একত্রিত করা হবে।
হযরত আলী (রাঃ) এক ইয়াহূদীকে জিজ্ঞেস করেনঃ “জাহান্নাম কোথায়?” ইয়াহূদী উত্তরে
বলেঃ “সমুদ্রে।” হযরত আলী (রাঃ) তখন
বলেনঃ “আমার মনে হয় একথা
সত্য।” কুরআন কারীমে বলা
হয়েছেঃ
وَالْبَحْرِ
الْمَسْجُورِ
অর্থাৎ “শপথ উদ্বেলিত সমুদ্রের।” (৫২ঃ ৬) আরও রয়েছেঃ
وَإِذَا
الْبِحَارُ فُجِّرَتْ অর্থাৎ “সমুদ্র যখন স্ফীত
হবে।” হযরত ইবনে আব্বাস
(রাঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা উত্তপ্ত বাতাস
প্রেরণ করবেন। ঐ বাতাস সমুদ্রের পানি তোলপাড় করে ফেলবে। তারপর তা এক শিখাময় আগুনে পরিণত হবে।
وَالْبَحْرِ الْمَسْجُورِ -এ আয়াতের তাফসীরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
করা হয়েছে ।(সূরাঃ তূর/৫২,
আয়াতঃ ৬)
হযরত মুআবিয়া ইবনে সাঈদ
(রাঃ) বলেন যে, ভূমধ্য সাগর
বরকতপূর্ণ। এ সাগর পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সব সাগর তাতে মিলিত হয়। এমনকি
সবচেয়ে বড় সাগরও এই সাগরে গিয়ে মিলিত হয়। এই সাগরের নীচে ঝর্ণা রয়েছে। সেই
ঝর্ণার মুখ তামা দিয়ে বন্ধ করা রয়েছে। কিয়ামতের দিন সেই মুখ বিস্ফোরিত হয়ে
আগুন জ্বলে উঠবে। এটা খুবই বিস্ময়কর। তবে সুনানে আবু দাউদে একটি হাদীস রয়েছে যে, হজ্জ ও উমরাহ
পালনকারীরা, জিহাদকারীরা বা
গাষীরা যেন দুধ-সমুদ্রে সফর করে। কেননা, সমুদ্রের নীচে আগুন এবং সেই আগুনের নীচে পানি রয়েছে। সূরা ফাতিরের তাফসীরে এ
সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
سُجِّرَتْ -এর অর্থ ‘শুকিয়ে দেয়া হবে’ এটাও করা হয়েছে।
অর্থাৎ এক বিন্দুও পানি থাকবে না। আবার প্রবাহিত করে দেয়া হবে এবং এদিক-ওদিক
প্রবাহিত হয়ে যাবে’ এ অর্থও কেউ কেউ
করেছেন।
এরপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ প্রত্যেক
প্রকারের লোককে (তাদের সহচর সহ) মিলিত করা হবে। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ
احْشُرُوا الَّذِينَ ظَلَمُوا وَأَزْوَاجَهُمْ
অর্থাৎ “একত্রিত কর জালিমদেরকে ও তাদের সহচরদেরকে।” (৩৭ঃ ২২)
হাদীস শরীফে আছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তির হাশর করা হবে তার কওমের সাথে যারা তার মতই আমল করে থাকে।৫ আল্লাহ্ তা'আলার নিম্নের উক্তি
দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছেঃ
وَكُنتُمْ أَزْوَاجًا ثَلَاثَةً -
فَأَصْحَابُ
الْمَيْمَنَةِ مَا أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ -
وَأَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ مَا
أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ -
وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ
অর্থাৎ “তোমরা বিভক্ত হয়ে
পড়বে তিন শ্রেণীতে-ডান দিকের দল, কত ভাগ্যবান ডান দিকের দল! এবং বাম দিকের দল, কত হতভাগ্য বাম দিকের দল! আর অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী।” (৫৬ঃ ৭-১০)
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার (রাঃ)
খুৎবাহ পাঠ করার সময় এ আয়াত পাঠ করেন এবং বলেনঃ “প্রত্যেক জামাআত বা দল তাদের মত জামাআত বা দলের সাথে মিলিত হবে।” অন্য এক বর্ণনায়
রয়েছে যে, একই রকম আমলকারী
দুই ব্যক্তি হয় তো একত্রে জান্নাতে থাকবে অথবা জাহান্নামে পাশাপাশি জ্বলবে।
হযরত উমার (রাঃ)-কে এ
আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “পুণ্যবান পুন্যবানের সাথে জান্নাতে মিলিত হবে এবং পাপী পাপীর সাথে জাহান্নামে
মিলিত হবে।” অর্থাৎ জান্নাতে
এবং জাহান্নামে সম আমলের মানুষ জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করবে।
হযরত ইবনে আব্বাস
(রাঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ সব
মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত হবে। ডান দিকের দল, বাম দিকের দল এবং অগ্রবর্তী দল। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, একই ধরনের লোক এক
সাথে থাকবে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-ও এ কথা পছন্দ করেন।
দ্বিতীয় উক্তি হলো এই যে, আরশের কিনারা থেকে
পানির একটা সমুদ্র আত্মপ্রকাশ করবে এবং তা চল্লিশ বছর পর্যন্ত প্রশস্ত আকারে
প্রবাহিত হবে। সেই সমুদ্র থেকে সকল মৃত পচা গলা ভেসে উঠবে। এটা এভাবে হবে যে, যারা তাদেরকে চিনে
তারা তাদেরকে এক নজর দেখলেই চিনতে পারবে। তারপর রূহসমূহ ছেড়ে দেয়া হবে এবং
প্রত্যেক রূহ তার দেহ অধিকার করবে। وَإِذَا النُّفُوسُ زُوِّجَتْ -এ আয়াতের অর্থ এটাই যে, দেহে আত্মা পুনঃসংযোজিত হবে। আবার এ অর্থও করা হয়েছে যে, মুমিনদের জোড়া
হ্রদের সাথে লাগিয়ে দেয়া হবে এবং কাফিরদের জোড়া লাগিয়ে দেয়া হবে শয়তানের
সাথে।৬
আল্লাহ্ তা'আলার উক্তি
وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ - بِأَيِّ
ذَنبٍ قُتِلَتْ
এটা জমহূরের কিরআত।
জাহিলিয়াতের যুগে জনগণ কন্যা সন্তানদেরকে অপছন্দ করতো এবং তাদেরকে জীবন্ত দাফন করতো। তাদেরকে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবেঃ এরা কেন নিহত
হয়েছে?' যাতে এদেরকে হত্যাকারীদের অধিক ধমক দেয়া হয় ও লজ্জিত করা হয়। আর এটাও জানার
বিষয় যে, অত্যাচারিতকে
প্রশ্ন করা হলে অত্যাচারী স্বভাবতই অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হবে।
এটাও বলা হয়েছে যে, তারা নিজেরাই জিজ্ঞেস করবেঃ ‘তাদেরকে কিসের ভিত্তিতে বা কি কারণে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়েছে?
এ সম্পর্কে বর্ণিত
হাদীসসমূহ ঃ
উকাশার ভগ্নী জুযামাহ
বিনতু অহাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে জনগণের মধ্যে বলতে শুনেনঃ “আমি গর্ভাবস্থায়
স্ত্রী সহবাস হতে জনগণকে নিষেধ করার ইচ্ছা করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম যে, রোমক ও পারসিকরা
গর্ভাবস্থায় স্ত্রী সহবাস করে থাকে এবং তাতে তাদের সন্তানের কোন ক্ষতি হয় না।” তখন জনগণ তাঁকে
বীর্য বাইরে ফেলে দেয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “এটা গোপনীয়ভাবে
জীবন্ত দাফন করারই নামান্তর। আর وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ -এর মধ্যে এরই বর্ণনা রয়েছে।”৭
হযরত সালমা ইবনে ইয়াযীদ
আরজাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি এবং আমার ভাই
রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)!
আমাদের মাতা মুলাইকা আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখতেন, অতিথি সেবা করতেন, এ ছাড়া অন্যান্য
নেক আমলও করতেন। তিনি অজ্ঞতার যুগে মারা গেছেন। এসব সৎ আমল তার কোন কাজে আসবে কি? তিনি উত্তরে বললেনঃ “না।” আমরা বললামঃ তিনি
জাহিলিয়াতের যুগে আমাদের এক বোনকে জীবন্ত প্রোথিত করেছিলেন। এতে তার কোন কুফল হবে
কি? তিনি জবাব দিলেনঃ “যাকে জীবন্ত দাফন
করা হয়েছে এবং যে দাফন করেছে উভয়েই জাহান্নামে যাবে। তবে হ্যাঁ, পরে ইসলাম গ্রহণ
করলে সেটা অন্য কথা।”৮
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)
হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
বলেছেনঃ “যে জীবন্ত দাফন করে
এবং যাকে জীবন্ত দাফন করা হয় তারা উভয়েই জাহান্নামী।”৯
খানসা বিনতে মুআবিয়া
সারীমিয়্যহ্ (রাঃ) তার চাচা হতে বর্ণনা করেছেন। যে, তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল
(সাঃ)! জান্নাতে কারা যাবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “নবী, শহীদ, শিশু এবং যাদেরকে
জীবন্ত অবস্থায় দাফন করা হয়েছে তারা জান্নাতে যাবে।”১০
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)
বলেন, মুশরিকদের শিশুরা
জান্নাতে যাবে । যারা বলে যে, তারা (মুশরিকদের শিশুরা) জাহান্নামে যাবে তারা মিথ্যাবাদী। কেননা, আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ - بِأَيِّ
ذَنبٍ قُتِلَتْ
-এর দ্বারা জীবিত প্রোথিত কন্যা শিশুকে বুঝানো হয়েছে।১১
হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব
(রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত কায়েস ইবনে
আসিম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! জাহিলিয়াতের যুগে আমি আমার কন্যাদেরকে জীবিত প্রোথিত
করেছি (এখন কি করবো?)।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ
(সঃ) বললেনঃ “তুমি প্রত্যেকটি
কন্যার বিনিময়ে একটি করে গোলাম আযাদ করে দাও।” তখন হযরত কায়েস (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি তো উটের মালিক (গোলামের মালিক তো আমি নই?)।” তিনি বললেনঃ “তাহলে তুমি
প্রত্যেকের বিনিময়ে একটি করে উট আল্লাহর নামে কুরবানী করে দাও।”১২
অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, হযরত কায়েস (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি বারো বা তোরোটি কন্যাকে জীবন্ত দাফন করেছি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বললেনঃ “তাদের সংখ্যা
অনুযায়ী গোলাম আযাদ করে দাও। তিনি বললেনঃ “ঠিক আছে, আমি তাই করবো।” পরবর্তী বছর তিনি
একশ'টি উট নিয়ে এসে
বললেনঃ “হে আল্লাহ্র রাসূল
(সঃ)! আমি মুসলমানদের সাথে যা করেছি তার জন্যে আমার কওমের পক্ষ থেকে এই সাদকা নিয়ে এসেছি।”
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “আমি ঐ উটগুলো
রক্ষণাবেক্ষণ করতাম। ঐগুলোর নাম কারসিয়্যাহ রেখেছিলাম।”
এরপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ যখন আমলনামা উন্মোচিত
হবে। অর্থাৎ আমলনামা বন্টন করা হবে। কারো ডান হাতে দেয়া হবে এবং কারো বাম হাতে
দেয়া হবে। কাতাদাহ্ (রঃ) বলেনঃ হে আদম সন্তান! তুমি যা লিখাচ্ছো সেটা কিয়ামতের
দিন একত্রিতাবস্থায় তোমাকে প্রদান করা হবে। সুতরাং মানুষ কি লিখাচ্ছে এটা তার
চিন্তা করে দেখা উচিত।
আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ আসমানকে ধাক্কা
দিয়ে টেনে নেয়া হবে, তারপর গুটিয়ে
নিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হবে। জাহান্নামকে উত্তপ্ত করা হবে। আল্লাহ্র গযবে ও বানী
আদমের পাপে জাহান্নামের আগুন তেজদীপ্ত হয়ে যাবে। এসব কিছু হয়ে যাওয়ার পর
প্রত্যেক মানুষ পার্থিব জীবনে কি আমল করেছে তা জেনে নিবে। সব আমল তার সামনে
বিদ্যমান থাকবে। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
يَوْمَ تَجِدُ كُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ مِنْ
خَيْرٍ مُّحْضَرًا وَمَا عَمِلَتْ مِن سُوءٍ تَوَدُّ لَوْ أَنَّ بَيْنَهَا
وَبَيْنَهُ أَمَدًا بَعِيدًا
অর্থাৎ “সেদিন প্রত্যেকে সে
যে ভাল কাজ করেছে এবং সে যে মন্দ কাজ করেছে তা বিদ্যমান পাবে, সে দিন সে তার ও ওর
(মন্দ কর্মফলের) মধ্যে দূর ব্যবধান কামনা করবে।” (৩ : ৩০) আল্লাহ্ তা'আলা আরো বলেনঃ
يُنَبَّأُ الْإِنسَانُ يَوْمَئِذٍ بِمَا
قَدَّمَ وَأَخَّرَ
অর্থাৎ “সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে সে কি অগ্রে পাঠিয়েছে এবং কি পশ্চাতে রেখে গেছে।” (৭৫ঃ ১৩)।
হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন
যে, যখন إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ সূরাটি নাযিল হয় এবং عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّا أَحْضَرَتْ পর্যন্ত পৌছে তখন হযরত উমার
(রাঃ) বলেনঃ “পূর্ববর্তী সকল কথা
এ জন্যেই বর্ণনা করা হয়েছে।১৩
--
১৫। কিন্তু না, আমি
প্রত্যাবর্তনকারী তারকাপুঞ্জের শপথ করছি;
৬। যা গতিশীল ও স্থিতিবান;
১৭। শপথ নিশার যখন ওর অবসান হয়
১৮। আর উষার যখন ওর আবির্ভাব হয়,
১৯। নিশ্চয়ই এই কুরআন সম্মানিত বার্তাবহের আনীত বাণী,
২০। যে সামর্থশালী, আরশের মালিকের নিকট মর্যাদা
সম্পন্ন,
২১। যাকে সেথায় মান্য
করা হয় এবং যে বিশ্বাস ভাজন।
২২। এবং তোমাদের সহচর উন্মাদ নয়,
২৩। সে তো তাকে স্পষ্ট
দিগন্তে অবলোকন করেছে।
২৪। সে অদৃশ্য বিষয়
সম্পর্কে কৃপণ নয়।
২৫। এবং এটা অভিশপ্ত
শয়তানের বাক্য নয়।
২৬। সুতরাং তোমরা কোথায় চলেছো?
২৭। এটা তো শুধু
বিশ্বজগতের জন্যে উপদেশ,
২৮। তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলতে চায়, তার জন্যে।
২৯। তোমরা ইচ্ছা করবে না, যদি জগতসমূহের
প্রতিপালক আল্লাহ ইচ্ছা না করেন।
--
হযরত আমর ইবনে হুরাইস
(রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি নবী (সঃ)-এর
পিছনে ফজরের নামায পড়েছি এবং তাঁকে ঐ নামাযে فَلَا أُقْسِمُ بِالْخُنَّسِ - الْجَوَارِ الْكُنَّسِ - وَاللَّيْلِ إِذَا
عَسْعَسَ - وَالصُّبْحِ إِذَا تَنَفَّسَএই আয়াতগুলো পড়তে শুনেছি।”১৪
এখানে নক্ষত্ররাজির শপথ
করা হয়েছে যেগুলো দিনের বেলায় পিছনে সরে যায় অর্থাৎ লুকিয়ে যায় এবং রাতের
বেলায় আত্মপ্রকাশ করে। হযরত আলী (রাঃ) এ কথাই বলেন। অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীগণ
হতেও এ আয়াতের তাফসীরে এটাই বর্ণিত হয়েছে।
কোন কোন ইমাম বলেন যে, উদয়ের সময়
নক্ষত্রগুলোকে خُنَّسِবলা হয়। আর স্ব স্ব স্থানে ওগুলোকে
جَوَارِবলা হয় এবং লুকিয়ে যাওয়ার সময়
كُنَّسِবলা হয়। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা বন্য গাভীকে বুঝানো হয়েছে।
এও বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা হরিণ
উদ্দেশ্য।
ইবরাহীম (রঃ) হযরত
মুজাহিদ (রঃ)-কে এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “এ সম্পর্কে আমি
কিছু শুনেছি। তবে লোকে বলে যে, এর দ্বারা নক্ষত্রকে বুঝানো হয়েছে।” ইবরাহীম (রঃ) পুনরায় তাকে বলেনঃ “আপনি যা শুনেছেন তাই বলুন।” তখন হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ “আমি শুনেছি যে, এর অর্থ হলো নীল
গাভী, যখন সে নিজের
জায়গায় লুকিয়ে যায়।” অতঃপর ইবরাহীম (রঃ)
বলেনঃ “তারা আমার উপর এ
ব্যাপারে মিথ্যা আরোপ করেছে, যেমন তারা হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছে যে, তিনি আসফালকে আ’লার এবং আ’লাকে আসফালের যামিন
বানিয়েছেন। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এর মধ্যে কোন কিছু নির্দিষ্ট না করে বলেছেন যে, সম্ভবতঃ এখানে
তিনটি জিনিসকেই বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ নক্ষত্র, নীল গাভী এবং হরিণ।
وَاللَّيْلِ
إِذَا عَسْعَسَ এতে দু’টি উক্তি রয়েছে। একটি উক্তি এই যে, এর অর্থ হলোঃ শপথ রাত্রির, যখন ওটা স্বীয় অন্ধকারসহ এগিয়ে আসে। আর দ্বিতীয় উক্তি এই যে, এর অর্থ হলোঃ শপথ
রাত্রির যখন ওটা পিছনে সরে যায় অর্থাৎ যখন ওর অবসান হয়।
হযরত আবু আবদির রহমান
সালমী (রাঃ) বলেন যে, একদা হযরত আলী
(রাঃ) ফজরের নামাযের সময় বের হন এবং বলতে থাকেনঃ “বে (এর নামায) সম্পর্কে প্রশ্নকারীরা কোথায়?” অতঃপর তিনি وَاللَّيْلِ
إِذَا عَسْعَسَ - وَالصُّبْحِ إِذَا تَنَفَّسَ -এ আয়াত দু'টি পাঠ করেন।
অর্থাৎ “রাত্রির শপথ, যখন ওর অবসান হয়
এবং ঊষার শপথ, যখন ওর আবির্ভাব
হয়।”১৫ ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাই পছন্দ করেছেন যে, এ وَاللَّيْلِ إِذَا عَسْعَسَ - -এর অর্থ হলোঃ শপথ রাত্রির, যখন ওটা চলে যেতে থাকে। কেননা, এর বিপরীতে রয়েছেঃ وَالصُّبْحِ إِذَا تَنَفَّسَ অর্থাৎ ঊষার শপথ যখন ওর আবির্ভাব হয়। عَسْعَسَ -এর অর্থ ادبار বা পিছনে সরে যাওয়া অর্থাৎ বিদায় নেয়া, তার স্বপক্ষে কবির উক্তিকেই দলীল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন কোন এক কবি
বলেছেনঃ
حتى إذاالصبح له تنفسا * و الجاب عنها ليلها وعسعسا
অর্থাৎ “শেষ পর্যন্ত ঊষা
আবির্ভূত হলো এবং তা হতে রাত্রির অন্ধকার দূরীভূত হলে ও ওর অবসান হয়ে গেল।” এখানে
عَسْعَسَশব্দকে ادبار বা পিছনে সরে
যাওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
আমার মতে إِذَا عَسْعَسَ -এর অর্থ হবেঃ যখন ওর আবির্ভাব হয়। যদিও ادبار অর্থেও এটাকে
ব্যবহার করা শুদ্ধ। কিন্তু এখানে এ শব্দকে اقبال -এর অর্থে ব্যবহার করাই হবে বেশী যুক্তিযুক্ত। আল্লাহ্
তা'আলা যেন রাত্রি এবং
ওর অন্ধকারের শপথ করেছেন যখন ওটা এগিয়ে আসে বা যখন ওটা আবির্ভূত হয়। আর তিনি শপথ
করেছেন ঊষার এবং ওর আলোকের যখন ওটা আবির্ভূত হয় বা যখন ওর ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পায়।
যেমন তিনি বলেনঃ
والليل إذا يغشی - والنهار إذا تجلى
অর্থাৎ “শপথ রজনীর, যখন ওটা আচ্ছন্ন
করে এবং শপথ দিবসের, যখন ওটা আবির্ভূত
হয়।” (সূরাঃ লাইল/৯২, আয়াতঃ ১-২) আরও বলেনঃ
والضحى . والليل إذا سجى.
অর্থাৎ “শপথ পূর্বাহ্নের, শপথ রজনীর যখন ওটা
হয় নিঝুম।” (সূরাঃ দুহা/৯৩, আয়াতঃ ১-২)। আর এক জায়গায় বলেনঃ
فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ
سَكَنًا ۔
অর্থাৎ “তিনি সকাল
বিদীর্ণকারী ও তিনি রাত্রিকে করেছেন বিশ্রামের সময়।” (৬ঃ ৯৬) এ ধরনের আরো
বহু আয়াত রয়েছে। সবগুলোরই ভাবার্থ একই।
হ্যাঁ, তবে এ শব্দের একটা অর্থ পশ্চাদপসরণও রয়েছে। উসূলের পণ্ডিতগণ বলেন যে, এ শব্দটি সামনে
অগ্রসর হওয়া এবং পিছনে সরে আসা এই উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এরই প্রেক্ষিতে উভয়
অর্থই যথার্থ হতে পারে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ সকালের শপথ যখন
ওর আবির্ভাব হয়। যহাক (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ যখন সকাল প্রকাশিত হয়। কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছেঃ যখন
সকাল আলোকিত হয় এবং এগিয়ে আসে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ দিনের
আলো, যখন তা এগিয়ে আসে
এবং প্রকাশিত হয়।
এই শপথের পর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ এই কুরআন এক
বুযুর্গ, অভিজাত, পবিত্র ও সুদর্শন
ফেরেশতার মাধ্যমে প্রেরিত অর্থাৎ জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে প্রেরিত । এই ফেরেশতা
সামর্থশালী। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
عَلَّمَهُ
شَدِيدُ الْقُوَىٰ - ذُو مِرَّةٍ অর্থাৎ “তাকে শিক্ষা দান
করে শক্তিশালী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন
ফেরেশতা (জিবরাঈল আঃ)।” (৫৩ : ৫-৬)।
ঐ ফেরেশতা আরশের মালিকের
নিকট মর্যাদা সম্পন্ন । তিনি নূরের সত্তরটি পর্দার অভ্যন্তরে যেতে পারেন, তার জন্যে এর
সাধারণ অনুমতি রয়েছে। সেখানে তার কথা শোনা যায়। বহু সংখ্যক ফেরেশতা তার অনুগত
রয়েছেন। আকাশে তাঁর নেতৃত্ব রয়েছে। তার আদেশ পালন ও তাঁর কথা মান্য করার জন্য
বহু সংখ্যক ফেরেশতা রয়েছেন। আল্লাহ্র পয়গাম তাঁর রাসূল (সঃ)-এর নিকট পৌছানোর
দায়িত্বে তিনি নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি বড়ই বিশ্বাস ভাজন। মানুষের মধ্যে যিনি
রাসূল হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তিনিও পাক-সাফ ও পবিত্র। এ কারণেই এরপর বলা হয়েছেঃ তোমাদের
সাথী অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) উন্মাদ বা পাগল নন। তার মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটেনি।
তিনি জিব্রাঈল আমীন (আঃ)-কে তাঁর আসল আকৃতিতে ছয় শত পাখা সমেত আত্মপ্রকাশের সময়ে
প্রত্যক্ষ করেছেন। এটা বাতহার (মক্কার এক উপত্যকার) ঘটনা। ওটাই ছিল হযরত জিবরাঈল
(আঃ)-কে আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রথম দর্শন। আকাশের উন্মুক্ত
প্রান্তে হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর এই দর্শন আল্লাহর নবী (সঃ) লাভ করেছিলেন। নিম্নের
আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা'আলা তারই বর্ণনা
দিয়েছেনঃ
عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَىٰ -
ذُو مِرَّةٍ
فَاسْتَوَىٰ -
وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَىٰ -
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ -
فَكَانَ
قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَىٰ -
فَأَوْحَىٰ إِلَىٰ عَبْدِهِ مَا أَوْحَىٰ
অর্থাৎ “তাকে শিক্ষাদান করে
শক্তিশালী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন, সে নিজ আকৃতিতে
স্থির হয়েছিল, তখন সে
ঊধ্বদিগন্তে। অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে
দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওয়াহী
করবার তা অহী করলেন।” (৫৩ ঃ ৫-১০) এ আয়াতগুলোর তাফসীর সূরা নাজমের মধ্যে গত হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে
মনে হয় যে, এই সূরা মি'রাজের পূর্বে অবতীর্ণ
হয়েছে। কারণ এখানে শুধু প্রথমবারের দেখার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়বারের
দেখার কথা নিম্নের আয়াতগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ -
عِندَ
سِدْرَةِ الْمُنتَهَىٰ -
عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَىٰ -
إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ
مَا يَغْشَىٰ
অর্থাৎ “নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল প্রান্তবর্তী বদরী বৃক্ষের নিকট, যার নিকট অবস্থিত
বাসোদ্যান। যখন বৃক্ষটি, যদ্দ্বারা আচ্ছাদিত
হবার তদ্দ্বারা ছিল আচ্ছাদিত।” (৫৩ ঃ ১৩-১৬) এখানে দ্বিতীয়বার দেখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এই সূরা মি'রাজের পরে অবতীর্ণ হয়েছে بِضَنِينٍ অন্য কিরআতে بظنين রয়েছে, অর্থাৎ তাঁর প্রতি
কোন অপবাদ নেই। আর ضاد দিয়ে পড়লে অর্থ হবেঃ তিনি
কৃপণ বা বখীল নন, বরং আল্লাহ্র পক্ষ
থেকে কোন গায়েবের কথা তাঁকে অবহিত করা হলে তিনি তা যথাযথভাবে পৌছিয়ে দেন। এই
দুটি কিরাআতই বিশুদ্ধ ও সুপ্রসিদ্ধ। সুতরাং জিবরাঈল (আঃ) বার্তাবহ হিসেবে বার্তা
পৌছাতে কোন প্রকার ঘাটতি রাখেননি বা কোন প্রকারের অপবাদও আরোপ করেননি।
এই কুরআন অভিশপ্ত
শয়তানের বাণী নয়। শয়তান এটা ধারণ করতে পারে । এটা তার দাবী বা চাহিদার বস্তুও
নয় এবং সে এর যোগ্যও নয়। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ
وَمَا
تَنَزَّلَتْ بِهِ الشَّيَاطِينُ - وَمَا يَنبَغِي لَهُمْ وَمَا يَسْتَطِيعُونَ - إِنَّهُمْ
عَنِ السَّمْعِ لَمَعْزُولُونَ
অর্থাৎ “এই কুরআন নিয়ে
শয়তানরা অবতীর্ণ হয় নাই, এটা তাদের জন্যে
সমীচিনও নয় এবং এটা বহন করার তাদের শক্তিও নেই। তাদেরকে তো এটা শ্রবণ করা হতেও
দূরে রাখা রয়েছে।” (২৬: ২১০-২১২) এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ সুতরাং তোমরা
কোথায় চলেছো? অর্থাৎ কুরআনের
সত্যতা, বাস্তবতা ও
অলৌকিকতা প্রকাশিত হওয়ার পরও তোমরা এটাকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করছো কেন? তোমাদের
বিবেক-বুদ্ধি কোথায় গেল?
হযরত আবুবকর সিদ্দীক
(রাঃ)-এর কাছে বানু হানীফা গোত্রের লোকেরা মুসলমান হয়ে হাযির হলে তিনি তাদেরকে
বলেনঃ “ যে মুসাইলামা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবী করেছে এবং যাকে তোমরা আজ পর্যন্ত মানতে
রয়েছো, তার মনগড়া কথাগুলো
শুনাও তো?” তারা তা শুনালে দেখা গেল যে, তা অত্যন্ত বাজে শব্দে ফালতু বকবকানি ছাড়া কিছুই নয়। হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন
তাদেরকে বললেনঃ “তোমাদের
বিবেক-বুদ্ধি কি একেবারে লোপ পেয়ে গেছে? বাজে বকবকানিকে তোমরা আল্লাহর বাণী বলে মান্য করছো? এ ধরনের অর্থহীন ও
লালিত্যহীন কথনও কি আল্লাহর বাণী হতে পারে? এটা তো সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার।
এ অর্থও করা হয়েছেঃ তোমরা
আল্লাহর কিতাব থেকে এবং তাঁর আনুগত্য থেকে কোথায় পলায়ন করছো?
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ এটা তো শুধু
বিশ্ব জগতের জন্যে উপদেশ এবং নসীহত স্বরূপ। হিদায়াত প্রত্যাশী প্রত্যেক মানুষের
উচিত এই কুরআনের উপর আমল করা। এই কুরআন সঠিক পথ-প্রদর্শক এবং মুক্তির সনদ। এই বাণী
ছাড়া অন্য কোন বাণীতে মুক্তি বা পথনির্দেশ নেই। তোমরা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করতে
পার না এবং যাকে ইচ্ছা গুমরাহ্ বা পথভ্রষ্টও করতে পার না। এটা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্
তা'আলার ইচ্ছার উপর
নির্ভরশীল। তিনি সারা বিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই করে
থাকেন। তার ইচ্ছাই সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয় এবং পূর্ণতা লাভ করে।।
لِمَن
شَاءَ مِنكُمْ أَن يَسْتَقِيمَ -এই আয়াত শুনে আবু জাহল বলেঃ “তাহলে তো হিদায়াত ও গুমরাহী আমাদের আয়ত্ত্বাধীন ব্যাপার তার এ কথার জবাবে
আল্লাহ্ তা'আলা নিম্নের আয়াত
অবতীর্ণ করেনঃ
وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ
رَبُّ الْعَالَمِينَ
অর্থাৎ “তোমরা ইচ্ছা করবে
না, যদি জগতসমূহের
প্রতিপালক আল্লাহ্ ইচ্ছা না করেন।”
--
(সূরাঃ তাকভীর -এর তাফসীর সমাপ্ত)
--
❏ টীকাঃ
১. এ হাদীসটি মুসনাদে
আহমাদে বর্ণিত হয়েছে।
২. এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৩. এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৪. এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ)।
৫. এ হাদীসটি মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে।
৬. এটা ইমাম কুরতুবী (রঃ) তাযকিরাহ্ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
৭. এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম ইবনে মাজাহ
(রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ)
এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৮. এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৯. এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
১০. এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
১১. এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
১২. এ হাদীসটি মুসনাদে আবদির রাযাকে বর্ণিত হয়েছে।
১৩. এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
১৪. এ হাদীসটি ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
১৫. এটা আবু দাউদ তায়ালেসী (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
No comments:
Post a Comment