ইমাম মালিক (রঃ)-এর
মুআত্তা নামক হাদীস গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি জনগণকে নামায
পড়ান এবং ঐ নামাযে তিনি إِذَا السَّمَاء انشَقَّتْ এ সূরাটি পাঠ করেন। অতঃপর তিনি (সিজদার আয়াতে নামাযের মধ্যেই) সিজদা করেন।
নামায শেষে তিনি জনগণকে সংবাদ দেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এভাবে নামাযের মধ্যে সিজদা করেছেন।১
হযরত আবু রাফে (রাঃ) হতে
বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আবু
হুরাইরার (রাঃ) সাথে এশার নামায পড়েছি। তিনি নামাযে إِذَا السَّمَاء انشَقَّتْ সূরাটি পাঠ করেন
এবং (সিজদার আয়াতে) সিজদা করেন। আমি তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ
আমি আকূল কাসেমের (সঃ) পিছনে (নামায পড়েছি এবং তার সিজদার সাথে) সিজদা করেছি। আমি
তার সাথে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত (অর্থাৎ যতদিন বেঁচে আছি ততদিন পর্যন্ত) এই
স্থলে। সিজদা করতেই থাকবো।”২ সহীহ মুসলিম ও
সুনানে নাসাঈতে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ আমরা
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে إِذَا السَّمَاء انشَقَّتْ এবং اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ এই সূরাদ্বয়ে সিজদা করেছি।
--
করুণাময়, কৃপানিধান আল্লাহর
নামে শুরু করছি।
১। যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে,
২। এবং ওটা স্বীয়
প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে এবং ওকে তদুপযোগী করা হবে,
৩। এবং পৃথিবীকে যখন সম্প্রসারিত করা হবে।
৪। এবং পৃথিবী তার
অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে
নিক্ষেপ করবে এবং শূন্য গর্ভ হয়ে যাবে,
৫। এবং তার প্রতিপালকের আদেশ
পালন করবে, আর ওকে তদুপযোগী
করা হবে (তখন তোমরা পুনরুত্থিত হবেই)।
৬। হে মানব! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট পৌছানো পর্যন্ত যে কঠোর সাধনা করে থাকো পরে তুমি তার সাক্ষাৎ লাভ করবে।
৭। অনন্তর যাকে তার
দক্ষিণ হস্তে তদীয় কর্মলিপি প্রদত্ত হবে,
৮। তার হিসাব নিকাশ তো
সহজভাবে গৃহীত হবে।
৯। এবং সে তার স্বজনদের
নিকট প্রফুল্লচিত্তে ফিরে যাবে;
১০। এবং যাকে তার
কর্মলিপি তার পৃষ্ঠের পশ্চাদ্ভাগে দেয়া হবে
১১। ফলতঃ অচিরেই সে
মৃত্যুকে আহ্বান করবে।
১২। এবং জ্বলন্ত অগ্নিতেই
সে প্রবিষ্ট হবে।
১৩। সে তার স্বজনদের
মধ্যে তো সহর্ষে ছিল,
১৪। যেহেতু সে ভাবতো যে, সে কখনই
প্রত্যাবর্তিত হবে না।
১৫। হ্যাঁ (অবশ্যই প্রত্যাবর্তিত হবে), নিশ্চয়ই তার প্রতিপালক তার উপর সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন।
--
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ কিয়ামতের দিন আকাশ ফেটে যাবে, ওটা স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ পালনের জন্যে উৎকর্ণ হয়ে থাকবে এবং ফেটে যাওয়ার
আদেশ পাওয়া মাত্র ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তার করণীয়ই হলো আল্লাহর আদেশ
পালন। কেননা, এটা ঐ আল্লাহর আদেশ
যা কেউ ঠেকাতে পারে না, যিনি সবারই উপর
বিজয়ী সবকিছুই যার সামনে অসহায় ও নাচার ।
জমীনকে যখন সম্প্রসারিত
করে দেয়া হবে। অর্থাৎ জমীনকে প্রসারিত করা হবে, বিছিয়ে দেয়া হবে এবং প্রশস্ত করা হবে। হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রঃ) হতে বর্ণিত
আছে যে, নবী পাক (সঃ)
বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন
আল্লাহ তা'আলা জমীনকে চামড়ার
মত টেনে নিবেন । তাতে সব মানুষ শুধু দুটি পা রাখার মত জায়গা পাবে। সর্বপ্রথম
আমাকে ডাকা হবে। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আল্লাহ তা'আলার ডান দিকে থাকবেন। আল্লাহর কসম! হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর পূর্বে আল্লাহ তা'আলাকে কখনো দেখেননি। আমি
তখন বলবোঃ হে আমার প্রতিপালক! ইনি হযরত জিবরাঈল (আঃ), আমাকে খবর দিয়েছেন
যে, আপনি তাকে আমার
কাছে পাঠিয়েছেন। (এটা কি সত্য) তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ উত্তরে বলবেনঃ হ্যা, সত্য বলেছে।” অতঃপর আমি শাফাআতের
অনুমতিপ্রাপ্ত হবে এবং বলবোঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনার বান্দারা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে আপনার ইবাদত
করেছে ।!” ঐ সময় তিনি মাকামে
মাহমুদে থাকবেন।৩
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ পৃথিবী তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে ও শূন্যগর্ভ হবে
অর্থাৎ জমীন তার অভ্যন্তরভাগ থেকে সকল মৃতকে উঠিয়ে ফেলবে এবং এভাবে ও গর্ভ শূন্য
হয়ে যাবে। সেও প্রতিপালকের ফরমানের অপেক্ষায় থাকবে তার জন্যে এটাই করণীয়ও বটে।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট পৌছানো পর্যন্ত যে কঠোর সাধনা করে থাকো
পরে তোমরা তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করবে। অর্থাৎ তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি অগ্রসর
হতে থাকবে, আমল করতে থাকবে, অবশেষে একদিন তার
সাথে মিলিত হবে এবং তার সম্মুখে দাঁড়াবে। তখন তোমরা নিজেদের প্রচেষ্টা ও
কার্যাবলী স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে।
হযরত জাবির (রাঃ) হতে
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বলেছেনঃ “হযরত জিবরাঈল (আঃ)
বলেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)
আপনি যতদিন ইচ্ছা জীবন যাপন করুন, অবশেষে একদিন আপনার মৃত্যু অনিবার্য । যা কিছুর প্রতি মনের আকর্ষণ সৃষ্টি করার
করুন, একদিন তা থেকে
বিচ্ছেদ অবধারিত। যা ইচ্ছা আমল করুন, একদিন তার সাথে সাক্ষাৎ হবে।" مُلَاقِيهِশব্দের ’ ه ‘ 'সর্বনাম দ্বারা রব হবে বা প্রতিপালককে বুঝানো হয়েছে বলে কেউ কেউ মন্তব্য
করেছেন। তখন অর্থ হবেঃ তোমার সাথে তোমার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ হবেই। তিনি তোমাকে তোমার
সকল আমলের পারিশ্রমিক দিবেন। তোমার সকল প্রচেষ্টার প্রতিফল তোমাকে প্রদান করবেন। এ
উভয় কথাই পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ
হে আদম সন্তান! তোমরা চেষ্টা কর বটে কিন্তু নিজেদের চেষ্টায় তোমরা দুর্বল। সকল
চেষ্টা পুণ্যাভিমুখী যেন হতে পারে এ চেষ্টা করো। প্রকৃতপক্ষে পূণ্যকাজ করাবার এবং পাপকাজ হতে বিরত
রাখার শক্তি একমাত্র আল্লাহর। তাঁর সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ বলেনঃ যাকে
তার আমলনামা দক্ষিণ হস্তে দেয়া হবে তার হিসাব নিকাশ সহজেই নেয়া হবে। অর্থাৎ তার ছোট
খাট পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর খুটিনাটিভাবে যার আমলের হিসাব গ্রহণ করা হবে তার
ধ্বংস অনিবার্য। সে শাস্তি হতে পরিত্রাণ পাবে না।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বলেছেনঃ “(কিয়ামতের দিন) যার হিসাব যাচাই করা হবে, আযাব তার জন্য অবধারিত।” হযরত আয়েশা (রাঃ) একথা শুনে বলেনঃ আল্লাহ তা'আলা কি একথা বলেন নাই? “অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে প্রদান করা হবে তার হিসাব হবে সহজতর।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ
(সঃ) বলেন, সেটা তো হিসাবের
নামে দৃশ্যতঃ পেশ করা মাত্র (যথার্থ হিসাব নয়)। কিয়ামতের দিন যে ব্যক্তির হিসাব
যাচাই করা হবে, আযাব তার জন্যে
অবধারিত।” ৪
অন্য একটি বিওয়াইয়াতে
আছে যে, এটা বর্ণনা করার পর
রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় অঙ্গুলী স্বীয় হস্তের উপর রেখে যেভাবে কেউ কোন জিনিস
তন্ন তন্ন করে খুঁজে ঠিক সেইভাবে অঙ্গুলি নাড়াচাড়া করে বলেনঃ “অর্থাৎ যাকে তন্ন
তন্ন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সে আযাব থেকে বাঁচতে পারবে না।" হযরত আয়েশা (রাঃ)
বলেন যে, যার কাছ থেকে
যথারীতি হিসাব নেয়া হবে সে আযাব থেকে রক্ষা পাবে না। তাকে শাস্তি ভোগ থেকে রেহাই
দেয়া হবে না। حِسَابًا يَسِيرًاদ্বারা শুধু পেশকরণ বুঝানো হয়েছে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে
বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি
রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে তার কোন এক নামাযে বলতে শুনিঃ اللهم حسبنى حسابا يسيرا অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমার
হিসাব আপনি সহজভাবে গ্রহণ করুন।” তিনি এ নামায হতে ফারেগ হলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ হে, আল্লাহর রাসূল
(সঃ)! এ সহজ | হিসাব কি? তিনি উত্তরে বললেনঃ “শুধু আমলনামার
প্রতি দৃষ্টি দেয়ানো হবে। অর্থাৎ ভাসাভাসা নযর দেয়ানো হবে। তারপর বলা হবেঃ যাও, আমি তোমাকে মাফ করে
দিয়েছি। কিন্তু হে আয়েশা (রাঃ)! আল্লাহ তা'আলা যার কাছ থেকে হিসাব নিবেন সে ধ্বংস হয়ে যাবে। মোটকথা, যার ডান হাতে
আমলনামা দেয়া হবে সে তা পেশ হওয়ার পরপরই ছাড়া পেয়ে যাবে। তারপর দলীয় লোকদের
কাছে উফুল্লভাবে ফিরে আসবে।
হযরত সাওবান (রাঃ) হতে
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বলেছেনঃ “তোমরা আমল করতে
রয়েছে, কিন্তু প্রকৃত
অবস্থা কারো জানা নেই। শীঘ্রই এমন সময় আসবে যখন তোমরা নিজেদের আমলসমূহ চিনতে
পারবে। কোন কোন লোক উৎফুল্লভাবে দলীয় লোকদের সাথে মিলিত হবে। আর কোন কোন। লোক
বিমর্ষভাবে, মলিন মুখে এবং
উদাসীন চেহারায় ফিরে আসবে। যারা পিঠের কাছে বাম হাতে আমলনামা পাবে তারা
ক্ষতিগ্রস্ততা ও ধ্বংসের কথা ভেবে চীৎকার করবে, মৃত্যু কামনা করবে এবং জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে। পৃথিবীতে তারা খুব
হাসিখুশী বা নিশ্চিন্ত আরাম আয়েশে দিন কাটিয়েছে। পরকালের জন্যে সামান্যতম ভয়ও
তাদের ছিল না। আজ তাদেরকে সর্বপ্রকারের দুঃখ যাতনা, বিমর্ষতা, মলিনতা এবং
উদাসীনতা সবদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। তারা মনে করেছিল যে মৃত্যুর পর আর পুনরুত্থান
হবে না এবং আর কোন জীবন নেই। তারা আল্লাহ তা'আলার কাছে যাওয়ার কথা মোটেই বিশ্বাস করেনি।
তাই, আল্লাহ তাবারাকা
ওয়া তা'আলা বলেনঃ নিশ্চয়ই
তারা ফিরে যাবে । আল্লাহ অবশ্য তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। প্রথমবার তিনি যেভাবে
সৃষ্টি করেছেন দ্বিতীয় বারও সেভাবেই সৃষ্টি করবেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে পাপ ও
পূণ্য কর্মের প্রতিফল প্রদান করবেন। তিনি তাদের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন। তারা
যা কিছু করছে সে সম্পর্কে তিনি পূর্ণ ওয়াকিফহাল।
--
১৬। আমি শপথ করি
অস্তরাগের,
১৭। এবং রজনীর আর ওটা যা কিছুর সমাবেশ ঘটায় তার,
১৮। এবং শপথ চন্দ্রের, যখন ওটা পরিপূর্ণ হয়,
১৯। নিশ্চয় তোমরা একস্তর
হতে অন্য স্তরে আরোহণ
করবে।
২০। সুতরাং তাদের কি হলো
যে, তারা বিশ্বাস
স্থাপন করে না?
২১। এবং তাদের নিকট কুরআন পঠিত হলে তারা সিজদাহ করে না?
২২। পরন্তু কাফিরগণই
অসত্যারোপ করে।
২৩। অথচ তারা (মনে মনে)
যা পোষণ করে থাকে আল্লাহ তা সবিশেষ পরিজ্ঞাত।
২৪। সুতরাং তাদেরকে।
যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ প্রদান কর।
২৫। যারা ঈমান আনে ও
সৎকর্ম। করে তাদের জন্যে রয়েছে অবিচ্ছিন্ন পুরস্কার।
--
সূর্যাস্তকালীন আকাশের
লালিমাকে শফক বলা হয়। পশ্চিমাকাশের প্রান্তে এ লালিমার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
হযরত আলী (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস
(রাঃ), হযরত উবাদা ইবনে
সামিত (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা
(রাঃ), হযরত শাদদাদ ইবনে
আউস (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ), হযরত মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন (রঃ), হযরত মাকহুল (রঃ), হযরত বকর ইবনে
আবদিল্লাহ মাযানী (রঃ), হযরত বুকায়ের ইবনে
আশাজ (রঃ), হযরত মালিক (রঃ), হযরত ইবনে আবী যিব
(রঃ) এবং হযরত আবদুল আযীম ইবনে আবী সালমা মা, জিশান (রঃ) বলেন ঐ লালিমাকেই শফক বলা হয়। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে এটাও
বর্ণিত আছে যে, শফক হলো শুভ্রতা।
তবে কিনারা বা প্রান্তের লালিমাকে শফক বলা হয় সেটা সূর্যোদয়ের পূর্বেই হোক বা
সূর্যোদয়ের পরেই হোক। খলীল (রঃ) বলেন যে, ইশার সময় পর্যন্ত এ লালিমা অবশিষ্ট থাকে। জওহীর (রঃ) বলেন, যে সূর্য অস্তমিত
হওয়ার পর যে লালিমা বা আলোক অবশিষ্ট থাকে ওটাকে শফক বলা হয়। এটা সন্ধ্যার পর
থেকে নিয়ে ইশার নামাযের সময় পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। ইকরামা (রঃ) বলেন যে, মাগরিবের সময় থেকে
নিয়ে ইশার সময় পর্যন্ত এটা বাকী থাকে।
সহীহ মুসলিমে হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মাগরিবের সময় শফক অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকে।” অর্থাৎ এ সময়
পর্যন্ত মাগরিবের নামায আদায় করা যেতে পারে।” মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, শফকের অর্থ হলো
সারাদিন। অন্য এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, শফকের অর্থ হলো সূর্য। মনে হয় আলো এবং অন্ধকারের কসম খেয়েছেন। ইমাম ইবনে
জারীর (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ দিনের
প্রস্থান এবং রাত্রির আগমনের শপথ। অন্যরা বলেন যে, সাদা এবং লাল বর্ণের নাম শফক। এই শব্দটি اضداد এর অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ বিপরীত অর্থবোধক।
وسق- শব্দের অর্থ হলোঃ একত্রিত করেছে অর্থাৎ নক্ষত্ররাজি এবং যা কিছু রাত্রে বিচরণ
করে। আর শপথ চন্দ্রের, যখন তা পূর্ণ হয়।
অর্থাৎ চন্দ্র যখন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়ে পুর্ণ আলোকময় হয়ে যায় তার শপথ।
لَتَرْكَبُنَّ এর তাফসীর সহীহ বুখারীতে মারফু হাদীসে বর্ণিত আছে যে, এক অবস্থা থেকে
অন্য অবস্থার দিকে অগ্রসর হয়ে চলে যাবে। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন যে, যে বছর আসবে সেই
বছর পূর্বের বছরের চেয়ে খারাপ হবে।হযরত উমার (রাঃ), হযরত ইবনে মাসউদ
(রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস
(রাঃ) প্রমুখ গুরুজনও এটাই সমর্থন করেন এবং মক্কাবাসী ও কুফাবাসীর কিরআত দ্বারাও
এরই সমর্থন পাওয়া যায়।
শাবী (রঃ) বলেন যে, لَتَرْكَبُنَّ এর অর্থ হলোঃ হে নবী (সঃ)! তুমি এক আকাশের পর অন্য আকাশে আরোহণ করবে। এর
দ্বারা মিরাজকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এক মনযিলের পর অন্য মনযিলে আরোহণ করতে
থাকবে। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ নিজ নিজ আমল অনুযায়ী মনযিল অতিক্রম করবে। যেমন সহীহ হাদীসে
রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বলেছেনঃ “তোমরা ততামাদের
পূর্ববর্তীদের নীতি বা পন্থার উপর চলবে । এমন কি তারা যদি গোসাপের গর্তে প্রবেশ
করে থাকে তবে তোমরাও তাই করবে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহ রাসূল (সঃ) পূর্ববর্তীদের দ্বারা কি ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে বুঝানো
হয়েছে? তিনি উত্তরে বলেনঃ “তারা ছাড়া আর কারা
হবে?”
মাকহুল (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ
প্রতি বিশ বছর পর পর তোমরা কোন না কোন এমন কাজ আবিষ্কার করবে যা পূর্বে ছিল না।
আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ আসমান
ফেটে যাবে, তারপর ওটা লাল বর্ণ
ধারণ করবে এবং এর পরেও রঙ বদলাতেই থাকবে। এক সময় আকাশ ধূম্র হয়ে যাবে, তারপর ফেটে যাবে।
হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ পৃথিবীতে অবস্থানকারী হীন ও নিকৃষ্ট মর্যাদার বহু লোক আখেরাতে
উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে। পক্ষান্তরে পৃথিবীর উচ্চ মর্যাদাশীলও প্রভাবশালী বহু লোক
আখেরাতে মর্যাদাহীন, অপমানিত ও বিফল মনোরথ
হয়ে যাবে। ইকরামা (রঃ) এর অর্থ বর্ণনা করেন যে, প্রথমে দুধপানকারী, তারপর খাদ্য
ভক্ষণকারী প্রথমে যুবক ছিল, তারপর বৃদ্ধ
হয়েছে। হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, طَبَقًا عَن طَبَقٍ এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ কোমলতার পর কঠোরতা, কঠোরতার পর কোমলতা, আমীরীর পর ফকীরী ও
ফকীরীর পর আমীরী এবং সুস্থতার পর অসুস্থতা ও অসুস্থতার পর সুস্থতা।
হযরত জাবির ইবনে
আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “আদম সন্তান গাফলতী বা উদাসীনতার মধ্যে রয়েছে। তারা যে কি উদ্দেশ্যে সৃষ্ট
হয়েছে তার পরোয়া তারা মোটেই করে না।
আল্লাহ্ তা'আলা যখন কাউকে সৃষ্টি
করার ইচ্ছা করেন তখন একজন ফেরেশতাকে বলেন তার বিক, জন্ম-মৃত্যু ও পাপ-পুণ্য লিখে নাও।' আদিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে সেই ফেরেশতা চলে যান এবং অন্য ফেরেশতাকে আল্লাহ তার
কাছে পাঠিয়েদেন। তিনি এসে ঐ মানব-শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ঐ শিশু বুদ্ধি বিবেকের
অধিকারী হলে ঐ ফেরেশতাকে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তার পাপ-পুণ্য লিখবার জন্যে আল্লাহ্
তার উপর দু’জন ফেরেশতাকে
নিযুক্ত করেন। তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে এরা দু’জন চলে যান এবং মালাকুল মাউত (মৃত্যুর ফেরেশতা) তার নিকট আগমন করেন এবং তার
রূহ কব্য করে নিয়ে চলে যান। তারপর ঐ রূহ্ তার কবরের মধ্যে তার দেহে ফিরিয়ে দেয়া
হয়। তখন মালাকুল মাউত চলে যান এবং তাকে প্রশ্নোত্তর করার জন্যে কবরে দু’জন ফেরেশতা আসেন এবং
নিজেদের কাজ শেষ করে তারাও বিদায় গ্রহণ করেন। কিয়ামতের দিন পাপ-পুণ্যের
ফেরেশতাদ্বয় আসবেন এবং তার কাধ হতে তার আমলনামা খুলে নিবেন। তারপর তারা তার সাথেই
থাকবেন, একজন চালকরূপে এবং
অপরজন সাক্ষীরূপে। তারপর আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ
لقد كنت في غفلة من هذا .
অর্থাৎ তুমি এই দিবস
সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে।” (৫০ : ২২) তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) - لَتَرْكَبُنَّ
طَبَقًا عَن طَبَقٍ এ আয়াতটি পাঠ করলেন। অর্থাৎ এক অবস্থার পরে অন্য
অবস্থা। তারপর নবী করীম (সঃ) বললেনঃ “(হে জনমণ্ডলী!) তোমাদের সামনে বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। যা পালন করার
শক্তি তোমাদের নেই। সুতরাং তোমরা মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট সাহায্য
প্রার্থনা কর।”৫
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এসব
উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন যে, এর প্রকৃত ভাবার্থ
হলোঃ হে মুহাম্মদ (সঃ) তুমি একটার পর একটা কঠিন কঠিন কাজে জড়িয়ে পড়বে। যদিও
এখানে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু আসলে সব মানুষকেই সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, তারা কিয়ামতের দিন
একটার পর একটা বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করবে।
এরপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ তাদের কি হলো
যে, তারা ঈমান আনে না? আর কুরআন শুনে
সাজদায় অবনত হতে কে তাদেরকে বিরত রাখে? বরং এই কাফিররা তো উল্টো অবিশ্বাস করে মিথ্যা সাব্যস্ত করে এবং সত্য ও হকের বিরোধিতা
করে। তারা হঠকারিতা এবং মন্দের মধ্যে ডুবে আছে। তারা মনের কথা গোপন রাখলেও আল্লাহ্
তা'আলা সেসব ভালভাবেই
জানেন।
এরপর আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন
করে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি এই কাফিরদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ্ তা'আলা তাদের জন্য
যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।
তারপর বলেনঃ সেই শাস্তি
থেকে রক্ষা পেয়ে উত্তম পুরস্কারের যোগ্য তারাই যারা ঈমান এনে সকাজ করেছে। তারা পুরোপুরি, অফুরন্ত ও বেহিসাব
পুরস্কার লাভ করবে। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ عَطَاء
غَيْرَ مَجْذُوذٍ অর্থাৎ “এমন দান যা শেষ হবার নয়।” (১১ঃ১০৮) কেউ কেউ বলেছেন যে, غير عنون
এর অর্থ হলো غير منقوض অর্থাৎ হ্রাসকৃত নয়।
কিন্তু এর অর্থ ঠিক নয়। কেননা, প্রতি মুহূর্তে এবং সব সময়েই আল্লাহ্ রাব্বল আলামীন জান্নাতবাসীদের প্রতি
ইহসান করবেন এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। বলা যাবে যে, আল্লাহ্ পাকের
মেহেরবানী এবং অনুগ্রহের কারণেই জান্নাতীরা জান্নাত লাভ করেছে, তাদের আমলের কারণে
নয়। সেই মালিকের তো নিজের মাখলুকাতের প্রতি একটা চিরস্থায়ী অনুগ্রহ রয়েছে। তার
পবিত্র সত্তা চিরদিনের ও সব সময়ের জন্যে প্রশংসার যোগ্য। এ কারণেই জান্নাতবাসীদের
জন্যে আল্লাহ্র হামদ, তাসবীহ্
শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই সহজ করা হবে। কুরআন কারীমে আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
واخردعوهم أن الحمد لله رب العلمين
অর্থাৎ “তাদের শেষ ধ্বনি
হবেঃ প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্রই প্রাপ্য।”
--
সূরাঃ ইনশিকাক এর তাফসীর সমাপ্ত
--
❏ টীকাঃ
১. এ হাদীসটি সহীহ মুসলিম
ও সুনানে নাসাঈতেও বর্ণিত হয়েছে।
২. ইমাম বুখারী (রঃ)
হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এহাদীসের আরো সনদ রয়েছে।
৩. এ হাদীসটি ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৪. এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) ইমাম বুখারী (রঃ) ইমাম তিরমিযী (রঃ, ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে জারীর
(রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৫. এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা মুনকার হাদীস
এবং এর সনদের মধ্যে দুর্বল বর্ণনাকারী বেশ কয়েকজন
রয়েছেন। তবে এর অর্থ বিশুদ্ধ। এসব ব্যাপার আল্লাহ্ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
No comments:
Post a Comment