দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
--
১। শপথ উর্ধ্বশ্বাসে
ধাবমান অশ্বরাজির,
২। যারা ক্ষুরাঘাতে
অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত করে,
৩। যারা অভিযান করে প্রভাতকালে,
৪। এবং ঐ সময়ে ধুলি
উৎক্ষিপ্ত করে;
৫। অতঃপর শত্রু দলের
অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে-
৬। মানুষ অবশ্যই তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ।
৭। এবং নিশ্চয়ই সে নিজেই
এ বিষয়ে সাক্ষী;
৮। এবং অবশ্যই সে ধন সম্পদের আসক্তিতে অত্যন্ত কঠিন।
৯। তবে কি সেই সম্পর্কে অবহিত নয় সে যখন
কবরে যা আছে তা উত্থিত হবে ।
১০। এবং অন্তরে যা আছে তা প্রকাশ করা হবে?
১১। সেই দিন তাদের কি
ঘটবে, তাদের প্রতিপালক
অবশ্যই তা সবিশেষ অবহিত।
--
মুজাহিদের ঘোড়া যখন
আল্লাহর পথে জিহাদ করার উদ্দেশ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে এবং হ্রেষাধ্বনি দিতে দিতে
দৌড়ায়, আল্লাহ তা'আলা ঐ ঘোড়ার শপথ করছেন।
তারপর শপথ করছেন, ঐ ঘোড়াসমূহের যারা
পদাঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত করতে থাকে। তারপর প্রভাতকালে অভিযান শুরু করে।
অনন্তর ধুলি উড়ায়, তারপর শত্রুদলে
ঢুকে পড়ে।
রাসূলুল্লাহর (সঃ) পবিত্র
অভ্যাস ছিল এই যে, তিনি শত্রু বেষ্টিত
কোন জনপদে গমন করলে সেখানে রাত্রে অবস্থান করে আযানের শব্দ কান লাগিয়ে শোনার
চেষ্টা করতেন। আযানের শব্দ কানে এলে তিনি থেমে যেতেন, আর তা কানে না এলে
তিনি সঙ্গীয় সৈন্যদেরকে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিতেন।
অতঃপর সেই ঘোড়াসমূহের
ধুলি উড়ানো এবং শত্রু দলের মধ্যে প্রবেশকরণের শপথ করে, আল্লাহ তাবারাকা
ওয়া তা'আলা প্রকৃত প্রসঙ্গ
তুলে ধরেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে
বর্ণিত আছে যে, (الْعَادِيَاتِ) এর অর্থ হলো উট। হযরত আলী (রাঃ) এ কথাই বলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ শব্দের অর্থ হলো ঘোড়া।
হযরত আলী (রাঃ) এটা শোনার পর বলেনঃ “বদরের দিন আমাদের সাথে ঘোড়া ছিল কোথায়? ঘোড়া তো ছিল সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে যা শত্রুদের খবরের জন্যে বা ছোট খাট
ব্যাপারে পাঠানো হয়েছে।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে
আব্বাস (রাঃ) একদা হাতিমে বসেছিলেন এমন সময় একজন লোক এসে তাঁর কাছে এ আয়াতের
তাফসীর জানতে চাইলো। তিনি লোকটিকে বললেনঃ “এর অর্থ হলোঃ
মুজাহিদদের ঘোড়াসমূহ, যেগুলো যুদ্ধের
সময় শক্রদের উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়। তারপর রাত্রিকালে সেই ঘোড়ার আরোহী মুজাহিদ
নিজের শিবিরে এসে খাবার রান্নার জন্যে আগুন জ্বালিয়ে বসে।" লোকটি এ জবাব শুনে
হযরত আলীর (রাঃ) কাছে গেল। হযরত আলী (রাঃ) ঐ সময় জনগণকে যমযমের পানি পান
করাচ্ছিলেন। লোকটি হযরত আলী (রাঃ)-এর কাছেও একই প্রশ্ন করলো। হযরত আলী (রাঃ) বললেনঃ
“আমার পূর্বে তুমি
এটা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করেছো কি?” জবাবে লোকটি বললেনঃ “হ্যা, হযরত ইবনে আব্বাস
(রাঃ)কে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বলেছেন যে, এর অর্থ হলোঃ মুজাহিদদের ঘোড়া, যেগুলো যুদ্ধের সময় শত্রুদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পথে ধাবিত হয়।" হযরত আলী (রাঃ) তখন
লোকটিকে বললেনঃ “যাও, তাকে আমার কাছে
নিয়ে এসো।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এলে হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ তুমি না জেনে মানুষকে
ফতোয়া দিচ্ছ? আল্লাহর কসম!
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ছিল বদরের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আমাদের সাথে মাত্র দুটি ঘোড়া
ছিল। একটি হযরত যুবায়ের (রাঃ)-এর এবং অন্যটি হযরত মিকদাদ (রাঃ)-এর। কাজেই (الْعَادِيَاتِ ضَبْحًا) এ যুদ্ধ হতে পারে কি করে? এখানে আরাফাত থেকে মুযদালাফার দিকে যাওয়া এবং মুযদালাফা থেকে মিনার দিকে
যাওয়ার কথাই বুঝানো হয়েছে।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন “এ। কথা শুনে আমি আমার প্রথম কথা প্রত্যাহার করে নিয়েছি। হযরত আলী (রাঃ) যা
বলেছেন সেটাই আমিও বলতে শুরু করেছি।” মুযদালাফায় পৌঁছে হাজীরাও নিজেদের হাঁড়িতে রুটি তৈরীর জন্যে আগুন
প্রজ্জ্বলিত করে। মোটকথা হযরত আলী (রাঃ)-এর বক্তব্য হলো ঃ (الْعَادِيَاتِ ضَبْحًا) দ্বারা উটকে বুঝানো হয়েছে। ইব্রাহীম (রঃ), উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রঃ) প্রমুখ গুরুজনও একথাই বলেছেন। পক্ষান্তরে হযরত ইবনে
আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত আতা (রঃ) এবং
হযরত যহহাক (রঃ) বলেছেন যে, এখানে ঘোড়াকেই
বুঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) এটাই পছন্দ করেছেন। উপরন্তু হযরত ইবনে
আব্বাস (রাঃ), এবং হযরত আতা (রঃ)
হতে বর্ণিত আছে যে, (ضَبْحً) অর্থাৎ হাঁপানো, ঘোড়ার ও কুকুর
ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, হাঁপানোর সময়
তাদের মুখ থেকে যে উহ্ উহ্ শব্দ বের হয় ওটাকেই (ضَبْحً) বলে।
পরবর্তী আয়াতের অর্থ হলো
ঐ সব ঘোড়ার পা পাথরের সাথে ঘর্ষণ লেগে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হওয়া। অন্য একটি
অর্থ হচ্ছেঃ ঐ ঘোড়ার আরোহীর যুদ্ধের আগুন প্রজ্জ্বলিত করা। আবার যুদ্ধের সময় ধোকা বা প্রতারণা অর্থেও এটা ব্যবহৃত হয়েছে। কারো কারো মতে এর অর্থ হলোঃ
রাত্রিকালে নিজেদের অবস্থান স্থলে পৌঁছে আগুন জ্বালানো এবং মুযদালাফায় হাজীদের
মাগরিবের পর পৌঁছে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)
বলেনঃ আমার মতে সবচেয়ে নির্ভুল এবং যথার্থ বক্তব্য হলোঃ ঘোড়ার পা এবং ক্ষুরের
পাথরের সাথে ঘর্ষণ লেগে আগুন সৃষ্টি করা। তারপর সকাল বেলায় মুজাহিদদের শত্রুদের
উপর আকস্মিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া। যারা এ শব্দের অর্থ উট বলেছেন তারা বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ সকাল
বেলায় মুযদালাফা হতে মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। তারপর সবাই একটা কথার উপর একমত
যে, যেই স্থানে তারা
অবতরণ করেছেন, যুদ্ধের জন্যেই হোক
অথবা হজ্বের জন্যেই হোক, তারা ধূলি উড়িয়ে
পৌঁছেছেন। তারপর মুজাহিদীনের শত্র শিবিরে পৌঁছে যাওয়া । আবার এ অর্থও হতে পারে যে, সবাই একত্রিত হয়ে
মধ্যবর্তী স্থানে হাযির হওয়া।
এ ব্যাপারে আবু বকর
বাযযার (রঃ) একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। উসূলে হাদীসের পরিভাষায় হাদীসটিকে গারীব
বা দুর্বল বলা হয়েছে। ঐ হাদীসটিতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি সৈন্যদল পাঠান। কিন্তু একমাস অতিবাহিত হওয়ার পরও তাদের
কোন খবর আসেনি। এই সময়ে এই আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়। এতে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে ঐ
মুজাহিদদের কথা বলা হয়েছে যাদের ঘোড়া হাঁপাতে হাঁপাতে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছে।
তাদের পদাঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়েছে। সকাল বেলা তারা শত্ৰুদলের উপর পূর্ণ
বিক্রমের সাথে আক্রমণ করেছে। তাদের ক্ষুর থেকে ধূলি উড়ছিল। তারপর তারা জয়লাভ
করতঃ সবাই একত্রিত হয়ে অবস্থান করেছে।
এসব শপথের পর এবার যে
উদ্দেশ্যে শপথ করা হয়েছে আল্লাহ সে সব ব্যক্ত করছেন। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ
নিশ্চয়ই মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ এবং সে এটা নিজেও জানে। কোন দুঃখ কষ্ট ভোগ করলে সে
দিব্যি মনে রাখে, কিন্তু আল্লাহ তা'আলার বেহিসাব নিয়ামতের
কথা সে বেমালুম ভুলে যায়। মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে একটি হাদীস রয়েছে যে, (كَنُودٌ) তাকে বলা হয় যে একাকী খায়, ভৃত্যদেরকে প্রহার করে এবং কারো সাথে ভাল ব্যবহার করে না। তবে এ হাদীসের সনদ
উসূলে হাদীসের পরিভাষায় দুর্বল।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
আল্লাহ্ অবশ্যই সেটা অবহিত আছেন। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, এটা সে নিজেও অবহিত
আছে। তার অকৃতজ্ঞতা কথা ও কাজে প্রকাশ পায়। যেমন অন্যত্র রয়েছে।
مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَن يَعْمُرُواْ مَسَاجِدَ الله
شَاهِدِينَ عَلَى أَنفُسِهِمْ بِالْكُفْرِ
অর্থাৎ “মুশরিকরা যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরী স্বীকার করে তখন তারা আল্লাহর মসজিদের
রক্ষণাবেক্ষণ করবে এমন হতে পারে না।" (৯ঃ ১৭)।
অতঃপর আল্লাহপাক বলেনঃ অবশ্যই সে ধন সম্পদের আসক্তিতে প্রবল। তার কি ঐ সময়টির
কথা জানা নেই যখন কবরে যা আছে তা উথিত হবে? অর্থাৎ তার ধন সম্পদের মোহ খুব বেশী! সেই মোহে পড়ে সে আমার পথে আসতে অনীহা
প্রকাশ করে। পরকালের প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা'আলা আরো বলেনঃ সমাধিস্থ
মতদেরকে যখন জীবিত করা হবে তখনকার কথা কি তার জানা নেই? যা অন্তরসমূহে আছে
তা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। নিঃসন্দেহে তাদের প্রতিপালক তাদের অবস্থা সম্বন্ধে পূর্ণ
ওয়াকিফহাল। সমস্ত আমলের পূর্ণ প্রতিদান তাদের প্রতিপালক তাদেরকে প্রদান করবেন। এক
বিন্দু পরিমাণও জুলুম বা অবিচার করা হবে না। সকলেরই প্রাপ্যের ব্যাপারে তিনি সুবিচারের
পরিচয় দিবেন ।
--
(সূরাঃ আদিয়াত এর তাফসীর সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment