সূরাঃ নাবা/ ৭৮,মাক্কী | (আয়াতঃ ৪০, রুকূঃ ২)



দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি
১। তারা পরস্পর কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ?
২। সেই মহান সংবাদ সম্বন্ধে,
৩। যেই বিষয়ে তারা মতবিরধ করে থাকে!
৪। কখনই না, তাদের ধারণা অবাস্তব, তারা শীঘ্রই জানতে পারবে;
৫। আবার বলি কখনই না, তারা অচিরেই অবগত হবে।
৬। আমি কি পৃথিবীকে শয্যারূপে নির্মাণ করিনি ?
৭। ও পর্বতসমূহকে কীলক (রূপে) নির্মাণ করিনি?
৮। আমি সৃষ্টি করেছি তোমাদেরকে যুগলে যুগলে;
তোমাদের নিদ্রাকে করে দিয়েছি বিশ্রাম,
১০। করেছি রজনীকে আবরণ,
১১। এবং করেছি দিবসকে জীবিকা আহণের জন্যে(উপযোগী)।
১২। আর নির্মাণ করেছি তোমাদের উর্ধ্বদেশে সুদৃঢ় সপ্ত আকাশ
১৩। এবং সৃষ্টি করেছি একটি প্রদীপ্ত প্রদীপ।
১৪। আর বর্ষণ করেছি জলদজাল হতে প্রচুর বারি।
১৫। তদদ্বারা আমি উদাত করি শস্য ও উদ্ভিদ,
১৬। এবং বৃক্ষরাজি বিজড়িত উদ্যানসমূহ।
--
যে মুশরিকরা কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করতো এবং ওকে মিথ্যা প্রতিপন্ন। করার মানসে পরস্পরকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতো, এখানে আল্লাহ তা'আলা তাদের ঐ সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন এবং কিয়ামত যে অবশ্যই সংঘটিত হবে এটা বর্ণনা করতঃ তাদের দাবী খণ্ডন করছেন। তিনি বলেনঃ তারা একে অপরের নিকট কি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। অর্থাৎ তারা একে অপরকে কি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে? তারা কি কিয়ামত সম্পর্কে একে অপরের নিকট প্রশ্ন করছে। অথচ এটা তো এক মহা সংবাদ! অর্থাৎ এটা অত্যন্ত ভীতিপ্রদ ও খারাপ সংবাদ এবং উজ্জ্বল সুস্পষ্ট দিবালোকের মত প্রকাশমান।
হযরত কাতাদাহ (রঃ) ও হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ)نَّبَإِ الْعَظِيمِ দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান উদ্দেশ্য নিয়েছেন। কিন্তু হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই সঠিকতর বলে মনে হচ্ছে অর্থাৎ এর দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানই উদ্দেশ্য।
الَّذِي هُمْ فِيهِ مُخْتَلِفُونَ (যেই বিষয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য আছে), এতে যে মতানৈক্যের কথা বলা হয়েছে তা এই যে, এ বিষয়ে তারা দুটি দলে বিভক্ত রয়েছে। একটি দল এটা স্বীকার করে যে, কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে। আর অপর দল এটা স্বীকারই করে না।
এরপর আল্লাহ তা'আলা কিয়ামত অস্বীকারকারীদেরকে ধমকের সুরে বললেঃ কই , তাদের ধারণা অবাস্তব, অলীক, তারা শীঘ্রই জানতে পৰে। অৰ ৰলিঃ কখনই না, তারা অচিরেই জানবে। এটা তাদের প্রতি হ লার কঠিন ধমক ও ভীষণ শাস্তির ভীতি প্রদর্শন।

এরপর আল্লাহ তা'আলা স্বীয় বিস্ময়কর সৃষ্টির সূক্ষ্মতার বর্ণনা দেয়ার পর নিজের আজীমুশশান ক্ষমতার বর্ণনা দিচ্ছেন, যার দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, তিনি এসব জিনিস কোন নমুনা ছাড়াই প্রথমবার যখন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন তখন তিনি দ্বিতীয়বারও ওগুলো সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন। তাই তো তিনি বলেনঃআমি কি ভূমিকে শয্যা (রূপে) নির্মাণ করিনি?' অর্থাৎ আমি সমস্ত সৃষ্টজীবের জন্যে এই ভূমিকে কি সমতল করে বিছিয়ে দিইনি? এই ভাবে যে, ওটা তোমাদের সামনে বিনীত ও অনুগত রয়েছে। নড়াচড়া না করে নীরবে পড়ে রয়েছে। আর পাহাড়কে আমি এই ভূমির জন্যে পেরেক বা কীলক করেছি যাতে এটা হেলাদোলা না করতে পারে এবং ওর উপর বসবাসকারীরা যেন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

মহান আল্লাহ বলেনঃআমি সৃষ্টি করেছি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায়। অর্থাৎ তোমরা নিজেদেরই প্রতি লক্ষ্য কর যে, আমি তোমাদেরকে নর ও নারীর মাধ্যমে সৃষ্টি করেছি যাতে তোমরা একে অপর হতে কামবাসনা পূর্ণ করতে পার। আর এভাবেই তোমাদের বংশ বৃদ্ধি হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা অন্য জায়গায় বলেনঃ
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً
অর্থাৎতার নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া করেছেন।(৩০ : ২১)

মহান আল্লাহ বলেনঃআমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি বিশ্রাম।' অর্থাৎ তোমাদের দ্রিাকে আমি হট্টগোল গণ্ডগোল বন্ধ হওয়ার কারণ বানিয়েছি যাতে তোমরা আরাম ও শান্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের সারা দিনের শ্রান্তি-ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এর অনুরূপ আয়াত সূরায়ে ফুরকানে গত হয়েছে।

আল্লাহ্ তা'আলার উক্তিঃ আমি রাত্রিকে করেছি আবরণ।' অর্থাৎ রাত্রির অন্ধকার ও কৃষ্ণতা জনগণের উপর ছেয়ে যায়। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
 وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَاهَا
অর্থাৎশপথ রজনীর যখন সে ওকে আচ্ছাদিত করে।” (৯১ ঃ ৪) আরব কবিরাও তাঁদের কবিতায় রাত্রিকে পোশাক বা আবরণ বলেছেন।

হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, রাত্রি শান্তি ও বিশ্রামের কারণ হয়ে যায়।
অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃআমি দিবসকে জীবিকা, সংগ্রহের জন্যে (উপযোগী) করেছি।' অর্থাৎ রাত্রির বিপরীত দিকে আমি উজ্জ্বল করেছি। দিনের বেলায় আমি অন্ধকার দূরীভূত করেছি যাতে তোমরা ওর মধ্যে জীবিকা আহরণ করতে পার।

মহান আল্লাহর উক্তিঃ আর আমি নির্মাণ করেছি তোমাদের ঊর্ধ্বদেশে সুস্থিত সপ্ত আকাশ।' অর্থাৎ সাতটি সুউচ্চ, সুদীর্ঘ ও প্রশস্ত আকাশ তোমাদের ঊর্ধ্বদেশে নির্মাণ করেছি যেগুলো চমৎকার ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। সেই আকাশে তোমরা হীরকের ন্যায় উজ্জ্বল চকচকে নক্ষত্র দেখতে পাও। ওগুলোর কোন কোনটি পরিভ্রমণ করে ও কোন কোনটি নিশ্চল ও স্থির থাকে।

আল্লাহ তা'আলার উক্তিঃআর আমি সৃষ্টি করেছি প্রোজ্জ্বল দীপ।' অর্থাৎ আমি সূর্যকে উজ্জ্বল প্রদীপ বানিয়েছি যা সমগ্র পৃথিবীকে আলোকোজ্জ্বল করে থাকে এবং সমস্ত জিনিসকে ঝঝকে তকতকে করে তোলে ও সারা দুনিয়াকে আলোকময় করে দেয়।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃএবং আমি বর্ষণ করেছি মেঘমালা হতে প্রচুর বারি।' হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, প্রবাহিত বায়ু মেঘমালাকে এদিক ওদিক নিয়ে যায়। তারপর ঐ মেঘমালা হতে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষিত হয় এবং তা ভূমিকে পরিতৃপ্ত করে। আরো বহু তাফসীরকার বলেছেন যে, مُعْصِرَاتِ দ্বারা বায়ুই উদ্দেশ্য। কিন্তু কোন কোন মুফাসৃসির বলেছেন যে, এর দ্বারা ঐ মেঘ উদ্দেশ্য যা বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি বরাবর বর্ষাতেই থাকে।

আরবেامرءات مُعْصِرَاتِ   ঐ নারীকে বলা হয় যার মাসিক ঋতুর সময় নিকটবর্তী হয়েছে কিন্তু এখনো ঋতু শুরু হয়নি। অনুরূপভাবে এখানেও অর্থ এই যে, আকাশে মেঘ দেখা দিয়েছে কিন্তু এখনো মেঘ হতে বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়নি। হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, مُعْصِرَاتِ দ্বারা  আসমানকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু এটা খুবই দুর্বল উক্তি। এর দ্বারা উদ্দেশ্য মেঘ হওয়াই অধকতর প্রকাশমান উক্তি। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
اللَّهُ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَيَبْسُطُهُ فِي السَّمَاءِ كَيْفَ يَشَاءُ وَيَجْعَلُهُ كِسَفًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلَالِهِ -
অর্থাৎআল্লাহ, তিনি বায়ু প্রেরণ করেন, ফলে এটা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে, অতঃপর তিনি একে যেমন ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন, পরে একে খণ্ড-বিখণ্ড করেন এবং তুমি দেখতে পাও যে, ওটা হতে নির্গত হয় বারিধারা।” (৩০ঃ ৪৮)

ثَجَّاجًا -এর অর্থ হলো ক্রমাগত প্রবাহিত হওয়া এবং অত্যধিক বর্ষিত হওয়া। একটি হাদীসে রয়েছেঃঐ হজ্ব হলো সর্বোত্তম হজ্ব যাতেলাব্বায়েকখুব বেশী বেশী পাঠ করা হয়, খুব বেশী রক্ত প্রবাহিত করা হয় অর্থাৎ অধিক কুরবানী করা হয়।এ হাদীসেওثَجّ   শব্দ রয়েছে।

একটি হাদীসে রয়েছে যে, ইসহাযাহর মাসআলা, সম্পর্কে প্রশ্নকারিণী একজন সাহাবিয়া মহিলাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃতুলার পুঁটলী কাছে রাখবে।মহিলাটি বললেনঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার রক্ত যে অনবরত আসতেই থাকে। এই রিওয়াইয়াতেও ثَجّ শব্দ রয়েছে। অর্থাৎ বিরামহীনভাবে রক্ত আসতেই থাকে। সুতরাং এই আয়াতেও উদ্দেশ্য এটাই যে, মেঘ হতে বৃষ্টি অনবরত বর্ষিত হতেই থাকে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ ঐ পাক পবিত্র ও বরকতময় বারি দ্বারা অমি উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ, ঘন সন্নিবিষ্ট উদ্যান। এগুলো মানুষ ও অন্যান্য-অসুর আহারের কাজে লাগে। বর্ষিত পানি খালে বিলে জমা রাখা হয়। গরপর ঐ গনি পান করা হয় এবং বাগ-বাগিচা সেই পানি পেয়ে ফুলে-ফলে, রূপে-রসে সুশোভিত হয়। আর বিভিন্ন প্রকারের রঙ, স্বাদ ও গন্ধের ফলমূল মাটি হতে উৎপন্ন হয়, যদিও ভূমির একই খণ্ডে ওগুলো পরস্পর মিলিতভাবে রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও অন্যান্য গুরুজন বলেন যে, এর অর্থ হলো জমা বা একত্রিত। এটা আল্লাহ তা'আলার নিম্নের উক্তির মতঃ
وَفِي الْأَرْضِ قِطَعٌ مُّتَجَاوِرَاتٌ وَجَنَّاتٌ مِّنْ أَعْنَابٍ وَزَرْعٌ وَنَخِيلٌ صِنْوَانٌ وَغَيْرُ صِنْوَانٍ يُسْقَىٰ بِمَاءٍ وَاحِدٍ وَنُفَضِّلُ بَعْضَهَا عَلَىٰ بَعْضٍ فِي الْأُكُلِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
অর্থাৎপৃথিবীতে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন ভূখণ্ড, তাতে আছে দ্রাক্ষা-কানন, শস্যক্ষেত্র, একাধিক শিরাবিশিষ্ট অথবা এক শিরা বিশিষ্ট খজুর বৃক্ষ সিঞ্চিত একই পানিতে, আর ফল হিসেবে ওগুলোর কতককে কতকের উপর আমি শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি। অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে এতে রয়েছে নিদর্শন।" (১৩ঃ ৪)
--
১৭। নিশ্চয়ই নির্ধারিত আছে মীমাংসা দিবস;
১৮। সেই দিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে এবং তোমরা দলে দলে সমাগত হবে,
১৯। আকাশকে উন্মুক্ত করা হবে, ফলে ওটা হয়ে যাবে বহুদ্বার বিশিষ্ট।
২০। এবং সঞ্চালিত করা হবে পর্বতসমূহকে, ফলে সেগুলো হয়ে যাবে মরীচিকা (বৎ)।
২১। নিশ্চয়ই জাহান্নাম ওৎপেতে রয়েছে;
২২। (এটা হচ্ছে) অবাধ্য লোকদের অবস্থিতি স্থল,
২৩। সেথায় তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে,
২৪। সেথায় তারা কোন স্নিগ্ধ (বস্তুর) স্বাদ গ্রহণ করতে পাবে না, আর কোন পানীয়ও (পাবে না),
২৫। উত্তপ্ত সলিল ও পূঁজ ব্যতী;
২৬।  এটাই সমুচিত প্রতিফল।
২৭। তারা কখনো হিসাবের শংকা করতো না,
এবং তারা দৃঢ়তার সাথে আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করেছিল।
২৯। সবকিছুই আমি সংরক্ষণ করেছি লিখিতভাবে।
৩০। অতঃপর তোমরা আস্বাদ গ্রহণ কর, এখন আমি তো তোমাদের যাতনাই শুধু বৃদ্ধি করতে থাকবো
--
আল্লাহ তা'আলা يَوْمَ الْفَصْلِ অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সম্পর্কে বলেন যে, ওটা একটা নির্ধারিত দিন। ওটা পূর্বেও আসবে না এবং পরেও আসবে না, বরং ঠিক নির্ধারিত সময়েই আসবে। কিন্তু কখন আসবে তার সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা'আলারই রয়েছে। তিনি ছাড়া আর কারো এর জ্ঞান নেই। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَمَا نُؤَخِّرُهُ إِلَّا لِأَجَلٍ مَّعْدُودٍ -
অর্থাৎআমি ওটাকে শুধু নির্ধারিত সময়ের জন্যেই বিলম্বিত করছি।" (১১ঃ ১০৪)।

রশাদ হচ্ছেঃ সেই দিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে এবং তোমরা দলে দলে সমাগত হবে। প্রত্যেক উম্মত নিজ নিজ নবীর সাথে পৃথক পৃথক থাকবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ
অর্থাৎযেই দিন আমি সমস্ত মানুষকে তাদের ইমামদের সাথে আহ্বান করবো" (১৭ঃ ৭১)
يَوْمَ يُنفَخُ فِي الصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًا - এই আয়াতের তাফসীরে সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃউভয় শিংগার মধ্যবর্তী সময় হবে চল্লিশ।সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃচল্লিশ দিন?”  তিনি উত্তরে বললেনঃআমি বলতে পারি না। তারা আবার প্রশ্ন করলেনঃচল্লিশ মাস কি?"  তিনি জবাব দিলেনঃতা আমি বলতে পারবো নাতারা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃচল্লিশ বছর? " তিনি উত্তরে বললেনঃ  আমি এটাও বলতে অস্বীকার করছি। তিনি বলেনঃ অতঃপর আল্লাহ তা'আলা আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। ফলে যেভাবে উদ্ভিদ মাটি হতে অঙ্কুরিত হয়। তদ্রুপ মানুষ ভূ-পৃষ্ঠ হতে উখিত হতে থাকবে। মানুষের সারা দেহ পঁচে গলে যায়। শুধুমাত্র একটি জিনিস বাকী থাকে। তা হলো কোমরের মেরুদণ্ডের অস্থি। ঐ অস্থি থেকেই কিয়ামতের দিন মাখলুককে পুনর্গঠন করা হবে।

আকাশ উন্মুক্ত করা হবে, ফলে ওটা হবে বহু দ্বার বিশিষ্ট।" অর্থাৎ আকাশকে খুলে দেয়া হবে এবং তাতে ফেরেশতামণ্ডলীর অবতরণের পথ ও দরজা হয়ে যাবে।

আর চলমান করা হবে পর্বতসমূহকে, ফলে সেগুলো হয়ে যাবে মরীচিকা।যেমন আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ.
وَتَرَى الْجِبَالَ تَحْسَبُهَا جَامِدَةً وَهِيَ تَمُرُّ مَرَّ السَّحَابِ
অর্থাৎতুমি পর্বতসমূহ দেখছো ও ওগুলোকে জমাট বলে ধারণা করছো, অথচ ওগুলো কিয়ামতের দিন মেঘের ন্যায় চলতে থাকবে।" (২৭ঃ ৮৮) অন্য এক জায়গায় রয়েছেঃ
وَتَكُونُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنفُوشِ
অর্থাৎপর্বতসমূহ হবে ধূনিত রংগিন পশমের মত।" (১০১ : ৫)

এখানে আল্লাহ পাক বলেন যে, পর্বতগুলো হয়ে যাবে মরীচিকা। দর্শকরা মনে করবে যে, ওটা নিশ্চয়ই একটা কিছু, আসলে কিন্তু কিছুই নয়। শেষে ওটা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْجِبَالِ فَقُلْ يَنسِفُهَا رَبِّي نَسْفًا - فَيَذَرُهَا قَاعًا صَفْصَفًا - لَّا تَرَىٰ فِيهَا عِوَجًا وَلَا أَمْتًا
অর্থাৎতারা তোমাকে পর্বতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তুমি বলঃ আমার প্রতিপালক গুলোকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন। অতঃপর তিনি এক পরিণত করবেন মসৃণ সমতল ময়দানে। যাতে তুমি বক্রতা ও উচ্চতা দেখবে না” (২০১০৫-১০৭) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَيَوْمَ نُسَيِّرُ الْجِبَالَ وَتَرَى الْأَرْضَ بَارِزَةً
অর্থাৎস্মরণ কর, যেদিন আমি পৰ্বতকে করবো সঞ্চালিত এবং তুমি পৃথিবীকে দেখবে উন্মুক্ত প্রান্তর।” (১৮ঃ ৪৭)

আল্লাহ তা'আলার উক্তিঃনিশ্চয়ই জাহান্নাম ওঁৎ পেতে রয়েছে; (ওটা হবে) সীমালংঘনকারীদের প্রত্যাবর্তন স্থল।" যারা হলো উদ্ধত, নাফরমান ও রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণকারী। জাহান্নামই তাদের প্রত্যাবর্তন ও অবস্থান স্থল। হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদাহ (রঃ)-এর অর্থ এও করেছেন যে, কোন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যে পর্যন্ত না জাহান্নামের উপর দিয়ে করবে। যদি আমল ভাল হয় তবে মুক্তি পেয়ে যাবে, আর যদি আমল। খারাপ হয় তবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। হযরত সুফইয়ান সাওরী (রঃ) বলেন যে, ওর উপর তিনটি পুল বা সেতু রয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃসেথায় তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে।' حْقَابًا শব্দটিحقب      শব্দের বহুবচন। দীর্ঘ যুগকে  حقب   বলা হয়। কেউ কেউ বলেন যে, আশি বছরে এক حقب হয়। বারো মাসে হয় এক বছর। ত্রিশ দিনে এক মাস হয় এবং প্রতিটি দিন হাজার বছরের হবে। বহু সাহাবী এবং তাবেয়ী হতে এটা বর্ণিত আছে। কারো কারো মতে সত্তর বছরে এক حقب হয়। আবার কেউ কেউ বলেন যে, এক حقب এ হয় চল্লিশ বছর। বছরগুলোর প্রতিটি দিন হাজার বছরের। বাশীর ইবনে কা'ব (রঃ) তো বলেন যে, এক একটি দিন এরূপ বড় এবং এরূপ তিনশ বছরে একহকব। একটি মারফু হাদীসে আছে যে, حقب -এ মাসগুলো ত্রিশ দিনের, বছরগুলো বারো মাসের, বছরগুলোর দিনের সংখ্যা তিন যাট এবং প্রতিটি দিন দুনিয়ার গণনা হিসেবে এক হাজার বছরের হবে।

অন্য একটি বিওয়াইয়াতে আছে যে, আবু মুসলিম ইবনে আলা (রঃ) সুলাইমান তাইমী (রঃ) কে জিজ্ঞেস করেনঃজাহান্নাম হতে কেউ বের হবে কি?” সুলাইমান তাইমী (রঃ) উত্তরে বলেনঃআমি নাফে' (রঃ) হতে শুনেছি এবং তিনি শুনেছেন হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃআল্লাহর কসম! জাহান্নামে সুদীর্ঘকাল অবস্থান ব্যতীত কেউই জাহান্নাম হতে বের হবে না। তারপর বলেনঃআশির উপর কিছু বেশী বছরে এক حقب হয়। প্রতি বছরে তিনশ ষাট দিন রয়েছে তোমরা গণনা করে থাকো।

সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, জাহান্নামীরা জাহান্নামে সাতশ’ ‘হকবপর্যন্ত থাকবে। প্রতিটিহকবে' সত্তর বছর রয়েছে, প্রতিটি বছরের দিনের সংখ্যা হলো তিনশ ষাট এবং প্রতিটি দিন দুনিয়ার হাজার বছরের সমান।
হযরত মুকাতিল ইবনে হিব্বান (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতটি فَذُوقُوا فَلَن نَّزِيدَكُمْ إِلَّا عَذَابًا -এই আয়াত দ্বারা মানসূখ বা রহিত হয়ে গেছে।

হযরত খালিদ ইবনে মাদান (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতটি এবং إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ (অর্থাৎ জাহান্নামীরা জাহান্নামে থাকবে আল্লাহ যতদিন ইচ্ছা করবেন)এই আয়াতটি একত্ববাদীদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃএও হতে পারে যে, لَّابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا সম্পর্কযুক্ত হবে حَمِيمًا وَغَسَّاقًا  এর সাথে। অর্থাৎ ফুটন্ত পানি ও পুঁজএই একই শাস্তি যুগ যুগ ধরে হতে থাকবে। তারপর অন্য প্রকারের শাস্তি শুরু হবে। কিন্তু সঠিক কথা এই যে, জাহান্নামে অবস্থানকালের পরিসমাপ্তিই নেই।

হযরত হাসান (রঃ)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃআহকাব' এর অর্থ হলো জাহান্নামে চিরকাল অবস্থান করা। কিন্তু حقبবলা হয় সত্তর বছরকে যার প্রতিটি দিন দুনিয়ার এক হাজার বছরের সমান। হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, আহকাব কখনো শেষ হবার নয়। এক হাকব শেষ হলে অন্য হাকব শুরু হয়ে যাবে। এই আহকাবের সঠিক সময়ের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা'আলারই রয়েছে। তবে মানুষকে শুধু এতোটুকু জানানো হয়েছে যে, আশি বছরে এক حقب হয়। এক বছরের মধ্যে রয়েছে তিনশ ষাট দিন এবং প্রতিটি দিন দুনিয়ার এক হাজার বছরের সমান।

এরপর মহাপ্রতাপাতি আল্লাহ বলেনঃ সেথায় তারা আস্বাদন করবে না শৈত্য, না কোন পানীয়। অর্থাৎ জাহান্নামীদেরকে এমন ঠাণ্ডা জিনিস দেয়া হবে না যার ফলে তাদের কলিজা ঠাণ্ডা হতে পারে এবং ঠাণ্ডা পানীয় পান করতে দেয়া হবে না। বরং এর পরিবর্তে পান করতে দেয়া হবে ফুটন্ত পানি ও রক্ত পুঁজ।

  حَمِيمًএমন কঠিন গরমকে বলা হয় যার পরে গরম বা উষ্ণতার আর কোন স্তর নেই। আর غَسَّاقًا ৰলে জাহান্নামীদের ক্ষতস্থান হতে নির্গত রক্ত পুঁজ ইত্যাদিকে। ই মের মুকাবিলায় এমন শৈত্য দেয়া হবে যে, তা স্বয়ং যেন এটা আবাৰ এবং তাতে থাকবে অসহনীয় দুর্গন্ধ। সূরায়ে সাদ’ -এর মধ্যে غَسَّاقًا এর তাফসীর গত হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তির কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তা'আলা তার অশেষ রহমতের বদৌলতে আমাদেরকে তার সর্বপ্রকারের শাস্তি হতে রক্ষা করুন! আমীন!

কেউ কেউ بَرْدً শব্দের অর্থ ঘুমও বলেছেন। আরব কবিদের কবিতায়ও بَرْدً শব্দটি ঘুমের অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃএটাই উপযুক্ত প্রতিফল।' .
এখানে তাদের দুষ্কৃতি লক্ষ্যণীয়। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, হিসাব-নিকাশের কোন ক্ষণ আসবেই না। আল্লাহ যেসব দলীল প্রমাণ তাঁর নবীদের উপর অবতীর্ণ করেছেন, তারা এ সব কিছুকেই একেবারে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতো
كِذَّابًا শব্দটি মাসদারবা ক্রিয়ামূল। এই ওজনে আরো মাসদার রয়েছে।
আল্লাহ তা'আলার উক্তিঃসব কিছুই আমি সংরক্ষণ করেছি লিখিতভাবে। অs আমি আমার বান্দাদের সমস্ত আমল অবগত রয়েছি এবং ওগুলোকে লিখে রেখেছি। সবগুলোরই আমি প্রতিফল প্রদান করবোভাল কাজ হলে ভাল প্রতিফল এবং মন্দ কাজ হলে মন্দ প্রতিফল।
জাহান্নামীদেরকে বলা হবেঃ এখন তোমরা শান্তির স্বাদ গ্রহণ কর। এরকমই এবং এর চেয়েও নিকৃষ্ট শাস্তি বৃদ্ধি করা হবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন যে, জাহান্নামীদের জন্যে এর চেয়ে কঠিন ও নৈরাশ্যজনক কোন আয়াত আর নেই। তাদের শাস্তি সদা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। হযরত হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃআমি হযরত এবারবাহ আসলামী (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলামঃ জাহান্নামীদের জন্যে কঠিনতম আয়াত কোনটি?” তিনি উত্তরে বললেনঃআমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কেفَذُوقُوا فَلَن نَّزِيدَكُمْ ... -এ আয়াতটি পাঠ করার পর নিম্নের বাক্যটি বলতে শুনেছিঃকওমকে তাদের মহামহিমান্বিত আল্লাহর অবাধ্যাচরণ ধ্বংস করে দিয়েছে।
--
৩১। এবং নিশ্চয়ই সংযমশীল লোকদের জন্যেই সফলতা;
৩২। প্রাচীর বেষ্টিত কানন কলাপ ও আঙ্গুর;
৩৩। এবং সমবয়স্কা যুবতীবৃন্দ;
৩৪। এবং পূর্ণ পূত পরম্পরা গত পানপাত্র।
৩৫। সেথায় তারা শুনবে না অসার ও মিথ্যা বাক্য;
৩৬। এটাই তোমার প্রতিপালকের পরিগণিত অনুগ্রহের প্রতিদান।
--
পরহেযগার ও পুণ্যবানদের জন্যে আল্লাহর নিকট যেসব নিয়ামত ও রহমত রয়েছে সে সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বল আলামীন বলছেন যে, এই লোকগুলো হলো সফলকাম। এদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে এবং এরা জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ লাভ করে জান্নাতে পৌঁছে গেছে।

حَدَائِقَ বলা হয় খেজুর ইত্যাদির বাগানকে। এই পুণ্যবান ও পরহেযগার লোকগুলো উদৃভিন্ন যৌবনা তরুণী অর্থাৎ হ্র লাভ করবে, যারা হবে উঁচু ও স্ফীত বক্ষের অধিকারিণী এবং সমবয়স্কা। যেমন সূরায়ে ওয়াকিআর তাফসীরে এর পূর্ণ বর্ণনা গত হয়েছে।

হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ নিশ্চয়ই জান্নাতীদের (গায়ের) জামাগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টিরূপে প্রকাশিত হবে। তাদের উপর মেঘমালা ছেয়ে যাবে এবং তাদেরকে ডাক দিয়ে বলা হবেহে জান্নাতবাসিগণ! তোমরা কি চাও যে, আমি তোমাদের উপর তা বর্ষণ করি?" (অতঃপর তারা যা কিছু চাইবে তা-ই তাদের উপর বর্ষিত হবে) এমন কি তাদের উপর সমবয়স্কা উদভিন্ন যৌবনা তরুণীও বর্ষিত হবে।

তারা পবিত্র শরাবের উপচে পড়া পেয়ালা একটির পর একটি লাভ করবে। তাতে এমন কোন নেশা হবে না যে, অশ্লীল ও অর্থহীন কথা তাদের মুখ দিয়ে বের হবে যা অন্য কেউ শুনতে পাবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
لَّا لَغْوٌ فِيهَا وَلَا تَأْثِيمٌ
অর্থাৎতথায় থাকবে না কোন অসার ও পাপের কথা। (সূরাঃ তুর/৫২, আয়াতঃ ২৩) অর্থাৎ তাতে কোন অধহীন বাজে কথা এবং অশ্লীল ও পাপের কথা প্রকাশ পাবে না। সেটা হলো দারুস সালাম বা শান্তির ঘর। যেখানে কোন দূষণীয় বা মন্দ কথাই প্রকাশ পাবে না

পুণ্যবানদেরকে এসব নিয়ামত তাদের সৎ কর্মের বিনিময় হিসেবে আল্লাহ তা'আলা দান করবেন। এটা হলো মহান আল্লাহর অশেষ করুণা ও রহমত। আল্লাহ পাকের এই করুণা ও অনুগ্রহ সীমাহীন, ব্যাপক ও পরিপূর্ণ। আরবরা বলে থাকেঃ
اعطانى فاحسننى অর্থাৎতিনি আমাকে ইনআম দিয়েছেন এবং পরিপূর্ণরূপেই দিয়েছেন। অনুরূপভাবে বলা হয়ঃ حسبى الله অর্থাৎসর্বদিক দিয়ে আল্লাহই আমার জন্যে যথেষ্ট।
--
৩৭। যিনি প্রতিপালক আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী এগুলোর অন্তর্বর্তী সবকিছুর , ‍যিনি দয়াময় ; তাঁর নিকট আবেদন নিবেদনের শক্তি তাদের থাকবে না।
৩৮। সেই দিন রূহ ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে; দয়াময় যাকে অনুমতি দিবেন সে ছাড়া ন্যেরা কথা বলবে না এবং সুসঙ্গত কথা বলবে।
৩৯। এদিস সুনিশ্চিত; অতএব যার অভিরুচি সে তার প্রতিপালকের শরণাপন্ন হোক।
৪০। আমি তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম; সেই দিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে এবং কাফির বলতে থাকবেঃ হায়রে হতভাগা আমি, যদি আমি মাটি হয়ে যেতাম!
--
আল্লাহ তা'আলা স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, একমাত্র তিনিই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যস্থিত সমস্ত মাখলুকের সষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তিনি রহমান বা পরম দয়াময়। তাঁর রহমত বা করুণা সব কিছু পরিবেষ্টন করে আছে। তার সামনে কেউ মুখ খুলতে পারবে না। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ 
অর্থাৎকে সে, যে তার অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করবে?" (২ঃ ২৫৫) আল্লাহ তা'আলা আর এক জায়গায় বলেনঃ
يَوْمَ يَأْتِ لَا تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلَّا بِإِذْنِهِ -
অর্থাৎযেই দিন ঐ সময় আসবে সেই দিন কেউই তার অনুমতি ছাড়া তাঁর সামনে মুখ খুলতে বা কথা বলতে সাহস পাবে না।” (১১: ১০৫)

রূহ দ্বারা হয়তো উদ্দেশ্য সমস্ত মানুষের রুহ বা সমস্ত মানুষ, অথবা এক প্রকারের বিশেষ মাখলূক যারা মানুষের মত আকার বিশিষ্ট, পানাহার করে থাকে, যারা ফেরেশতাও নয়, মানুষও নয়। অথবা রূহ দ্বারা হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে অন্য জায়গাতেও রূহ বলা হয়েছে। যেমনঃ
نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ - عَلَىٰ قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنذِرِينَ
অর্থাৎওটাকে বিশ্বস্ত আত্মা তোমার অন্তরে অবতীর্ণ করেছে যাতে তুমি ভয় প্রদর্শকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও।" (২৬ঃ ১৯৩-১৯৪) এখানে রূহ দ্বারা নিশ্চিত রূপেই হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। হযরত মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, সমস্ত ফেরেশতার মধ্যে বুযুর্গতম, অহী বাহক, আল্লাহর নৈকট্যলাভে সমর্থ হয়েছেন এমন ফেরেশতা হলে এই জিবরাঈল (আঃ)। অথবা রূহ দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে নিম্নের আয়াতটি পেশ করা যেতে পারেঃ
وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِّنْ أَمْرِنَا  ۔
র্থাৎএভাবেই আমি আমার আদেশে তোমার প্রতি অহী অবতীর্ণ কবি ।” (৪২ঃ ৫২) এখানে রূহ দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য। ষষ্ঠ উক্তি এই যে, এই রুহ হলেন সমগ্র মাখলূকের সম আয়তন বিশিষ্ট এক ফেরেশতা।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এই ফেরেশতা সমস্ত ফেরেশতা হতে বহু গুণে বড়।

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, রূহ নামক এই ফেরেশতা চতুর্থ আসমানে রয়েছেন। তিনি সমস্ত আকাশ, সমগ্র পাহাড়-পর্বত এবং সমস্ত ফেরেশতা হতে বড়। প্রত্যহ তিনি বারো হাজার তাসবীহ পাঠ করে থাকেন। প্রত্যেক তাসবীহ হতে একজন করে ফেরেশতা জন্ম লাভ করে থাকেন। কিয়ামতের দিন তিনি একাই একটি সারিরূপে আসবেন। কিন্তু এই উক্তিটি হাদীসের সংজ্ঞায় খুবই গরীব বা দুর্বল।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃফেরেশতাদের মধ্যে এমন এক কেরেশতাও রয়েছেন যে, যদি তাকে বলা হয়ঃ আকাশ ও পৃথিবীকে এক গ্রাসে নিয়ে নাও, তবে তিনি এক গ্রাসেই সবকে নিয়ে নিবেন। তার তাসবীহ হলোঃ  نتسبحانك حيث ك   অর্থাৎআমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি আপনি যেখানেই থাকুন না কেন।

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এসব উক্তি আনয়ন করেছেন, কিন্তু কোন ফায়সালা করেননি। আমার মতে তো এখানে রূহ দ্বারা সমস্ত মানুষকেই বুঝানো হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ দয়াময় যাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত (য়ে কথা বলবে না)।আল্লাহ পাকের এই উক্তিটি তার নিম্নের উক্তির মতইঃ
يَوْمَ يَأْتِ لَا تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلَّا بِإِذْنِهِ
অর্থাৎযখন ঐ দিন আসবে তখন তাঁর (আল্লাহর) অনুমতি ছাড়া কেউই। কথা বলবে না।” (১১ ঃ ১০৫) সহীহ হাদীসে রয়েছেঃসেইদিন রাসূলগণ ছাড়া কেউই কথা বলবে না।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃএবং সে যথার্থ বলবে।'
সর্বাধিক সত্য কথা হলোঃ   لا اله الا الله - অর্থাৎআল্লাহ ছাড়া কোন মা'বুদ নেই।

মহান আল্লাহর উক্তিঃ এই দিবস সুনিশ্চিত।' অর্থাৎ অবশ্যই এটা সংঘটিত হবে। অতএব যার অভিরুচি সে তার প্রতিপালকের শরণাপন্ন হোক। অর্থাৎ যে ইচ্ছা করবে সে তার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাবার পথ তৈরী করুক, যে পথে চলে সে সোজাভাবে তাঁর কাছে পৌঁছে যাবে।

মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃআমি তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি হতে সতর্ক করলাম।' অর্থাৎ কিয়ামতের শাস্তি হতে ভয় প্রদর্শন করলাম। যা আসবে তাকে এসেই গেছে মনে করা উচিতকারণ যা আসার তা আসবেই। সেই দিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে। ঐদিন নতুন, পুরাতন, ছোট, বড় এবং ভাল ও মন্দ সমস্ত আমল মানুষের সামনে থাকবে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ
وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا -
অর্থাৎতারা যে আমল করেছে তা উপস্থিত পাবে।” (১৮ঃ ৪৯) আর এক জায়গায় বলেনঃ
يُنَبَّأُ الْإِنسَانُ يَوْمَئِذٍ بِمَا قَدَّمَ وَأَخَّرَ -
অর্থাৎসেই দিন মানুষকে অবহিত করা হবে যা সে অগ্রে পাঠিয়েছে ও যা পশ্চাতে রেখে গেছে সে সম্পর্কে।” (৭৫ঃ ১৩)।

আর কাফির বলবেঃ হায়, আমি যদি মাটি হতাম।অর্থাৎ দুনিয়ায় যদি আমরা মাটিরূপে থাকতাম, যদি আমাদেরকে সৃষ্টিই না করা হতো এবং আমাদের কোন অস্তিত্বই না থাকতো তবে কতই না ভাল হতো! তারা সেদিন আল্লাহর আযাব স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। নিজেদের মন্দ ও পাপকর্মগুলো সামনে। থাকবে যেগুলো পবিত্র ফেরেশতাদের ন্যায়পূর্ণ হস্তে লিখিত হয়েছে।

সুতরাং একটি অর্থ তো এই হলো যে, তারা দুনিয়াতেই মাটি হবার আকাঙ্ক্ষা করবে। অর্থাৎ সৃষ্ট না হওয়া কামনা করবে। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, যখন জীবজন্তু গুলোর ফায়সালা হয়ে যাবে এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়ে দেয়া হবে, এমন কি দি শিংবিহীন বকরীকে শিংবিশিষ্ট বকরী মেরে থাকে তবে তারও প্রতিশোধ নিয়ে দেয়া হবে। তারপর তাদেরকে (জন্তুগুলোকে) বলা হবে তোমরা মাটি হয়ে যাও, তখন তারা মাটি হয়ে যাবে। তখন এই কাফির লোকও বলবেঃ হায়, যদি আমি (এদের মত) মাটি হয়ে যেতাম! অর্থাৎ যদি আমিও জন্তু হতাম এবং এভাবে মাটি হয়ে যেতাম তবে কতই না ভাল হতো!
সূরের (শিংগার) সুদীর্ঘ হাদীসেও এই বিষয়টি এসেছে এবং হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী হতেও এটা বর্ণিত হয়েছে।
--
(সূরাঃ নাবা এর তাফসীর সমাপ্ত)
--
টীকাঃ
১. এ হাদীসটি মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হযরত আবু উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। কিন্তু এ হাদীসটি অত্যন্ত মুনকার। এর একজন বর্ণনাকারী রয়েছে জাবির ইবনে যুরায়েরের পুত্র কাসেম এবং তার থেকে বর্ণনা করেছে জাফর ইবনে যুবায়ের। দুই জনই পরিত্যাজ্য।
. এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর একজন বর্ণনাকারী জাসর ইবনে ফারকাদ অত্যন্ত দুর্বল।
. এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
. এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল হাদীস। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উক্তি হওয়া সম্পর্কেও সমালোচনা করা হয়েছে। সম্ভবতঃ এটা হযরত আল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি হবে। আর ওটাও হয় তো তিনি বানী ইসরাঈল হতে হণ করেছেন। এ সব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।


No comments:

Post a Comment