এ সূরাটি যে মক্কী সূরা
তার প্রমাণ এই যে, হযরত বারা ইবনে
আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “নবী করীম (সঃ)-এর
সাহাবীদের মধ্যে যারা সর্ব প্রথম আমাদের নিকট (মদীনায়) আসেন তারা হলেন হযরত মুসআব
ইবনে উমায়ের (রাঃ) এবং হযরত ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ)। তাঁরা আমাদেরকে কুরআন
পড়াতে শুরু করেন। অতঃপর হযরত বিলাল (রাঃ), হযরত আম্মার (রাঃ) এবং হযরত সা'দ (রাঃ) আগমন করেন। তারপর হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বিশজন সাহাবী
সমভিব্যাহারে আমাদের কছে আসেন। তারপর নবী করীম (সঃ) আসেন। আমি মদিনাবাসীকে অন্য
কোন ব্যাপারে এতো বেশী খুশী হতে দেখিনি যতোটা খুশী তাঁরা নবী (সঃ) এবং তাঁর
সহচরদের আগমনে হয়েছিলেন। ছোট ছোট শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকরা পর্যন্ত আনন্দে
কোলাহল শুরু করে যে, ইনি হলেন আল্লাহর
রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। রাসুলুল্লাহ্ (সঃ)-এর আগমনের পূর্বেই আমি سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى
সূরাটি, এ ধরনের অন্যান্য
সূরাগুলোর সাথে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম।”
মুসনাদে আহমদে হযরত আলী
(রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى এই সূরাটিকে খুবই ভালবাসতেন।
সহীহ্ বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে
বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)
হযরত মুআয (রাঃ)-কে বলেনঃ “কেন তুমি নামাযে وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا-
سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى- এবং وَاللَّيْلِ
إِذَا يَغْشَى এই সূরাগুলো পড় না?” মুসনাদে আহমদে আরও বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) উভয় ঈদের নামাযে سَبِّحِ
اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى এবং هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ الْغَاشِيَةِ এ সূরা দুটি পাঠ করতেন। যদি ঘটনাক্রমে একই দিনে জুমআ ও ঈদের নামায পড়ে যেতো
তবে তিনি উভয় নামাযেই এই সূরা দু'টি পড়তেন।১
মুসনাদে আহমদে উম্মুল
মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বেতরের নামাযে سَبِّحِ
اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى قُلْ يَا أَيُّهَا
الْكَافِرُونَ- এবং قُلْ هُوَ
اللَّهُ أَحَدٌ এই সূরাগুলো পাঠ
করতেন। অন্য একটি বর্ণনায় আরো বাড়িয়ে বলা হয়েছে যে, قُلْ
أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِএবং قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ
النَّاسِ
এই সূরা দু'টিও পড়তেন।২
--
করুণাময়, কৃপানিধান আল্লাহর
নামে শুরু করছি।
১। তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর,
২। যিনি সৃষ্টি করেছেন
অতঃপর যথাযথভাবে সমন্বিত করেছেন,
৩। এবং যিনি নিয়ন্ত্রণ
করেছেন, তারপর পথ দেখিয়ে
দিয়েছেন,
৪। এবং যিনি তৃণাদি
সমুদিত করেছেন।
৫। পরে ওকে বিশুষ্ক
বিমলিন করেছেন।
৬। অচিরেই আমি তোমাকে পাঠ করাবো, ফলে তুমি বিস্মৃত
হবে না,
৭। আল্লাহ যা ইচ্ছা করবেন তদ্ব্যতীত, নিশ্চয়ই তিনি প্রকাশ্য ও গুপ্ত বিষয়
পরিজ্ঞাত আছেন।
৮। আমি তোমার জন্যে
কল্যাণের পথকে সহজ করে দিবো।
৯। অতএব উপদেশ যদি
ফলপ্রসূ হয় তবে উপদেশ
প্রদান কর।
১০। যারা ভয় করে তারা
উপদেশ গ্রহণ করবে।
১১। আর ওটা উপেক্ষা করবে সেই যে নিতান্ত হতভাগ্য,
১২। সে ভীষণ নরকানলে
প্রবেশ করবে,
১৩। অতঃপর সে সেখানে
মরবেও না, বাঁচবেও না।
--
মুসনাদে আহমদে হযরত উকবা
ইবনে আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন فسبح باسم ربك العظيم অবতীর্ণ হয় তখন
রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সাহাবীদেরকে বলেনঃ “এটাকে তোমরা রুকুর মধ্যে গ্রহণ করে নাও।” তারপর যখন سَبِّحِ
اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى অবতীর্ণ হলো তখন তিনি বললেনঃ “এটাকে তোমরা তোমাদের
সিজদাহর মধ্যে গ্রহণ কর।” ৩
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)
হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)
যখন سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى পাঠ করতেন তখন তিনি سبحان ربى
الا على
বলতেন।৪ হযরত আলী (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে আরো বর্ণিত
আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى পাঠ করে سبحان ربى الا على বলতেন এবং যখন তিনি لَا
أُقْسِمُ بِيَوْمِ الْقِيَامَةِ এ সূরাটি পাঠ করতেন
এবং শেষে أَلَيْسَ ذَلِكَ بِقَادِرٍ عَلَى أَن يُحْيِيَ الْمَوْتَى পড়তেন তখন سبحنك وبلى বলতেন।৫
আল্লাহ্ তা'আলা এখানে বলেনঃ তুমি তোমার
সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর যিনি সমস্ত মাখলুককে সৃষ্টি
করেছেন এবং সকলকে সুন্দর ও উন্নত আকৃতি দান করেছেন। যিনি মানুষকে সৌভাগ্যের পথ নির্দেশ করেছেন। যিনি পশুদের চারণভূমিতে তৃণ ও সবুজ ঘাসের ব্যবস্থা
কছে। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা অন্য জায়গায়
বলেনঃ
رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَى
অর্থাৎ “(হযরত মুসা বললেন) আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য
আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথ নির্দেশ
করেছেন।” (২০ঃ৫০) যেমন সহীহ্ মুসলিমে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)
বলেছেনঃ “আসমান ও জমীন
সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর সৃষ্ট জীবের ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেছেন। সেই সময় তার আরশ ছিল পানির
উপর।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ “যিনি তৃণাদি উৎপন্ন
করেন, পরে ওকে ধূসর
আবর্জনায় পরিণত করেন।
আরবের কোন কোন ভাষা-বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, এখানে اخوى শব্দটিকে যদিও শেষে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু অর্থের দিক
দিয়ে এটাকে প্রথমে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ যিনি ঘাস, তৃণ, শস্য, গাঢ় সবুজ রঙের করে
সৃষ্টি করেছেন, তারপর ওকে বিশুষ্ক
করেছেন।
এরপর আল্লাহ্ পাক স্বীয়
নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ) তোমাকে আমি নিশ্চয়ই পাঠ করাবো, ফলে তুমি বিস্মৃত
হবে না। তবে হ্যাঁ যদি স্বয়ং আল্লাহ্ কোন আয়াত ভুলিয়ে দিতে চান তবে সেটা
স্বতন্ত্র কথা। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ অর্থই পছন্দ করেন এবং তাতে এ আয়াতের অর্থ
হবেঃ যে কুরআন আমি তোমাকে পড়াচ্ছি তা ভুলে যেয়ো না। তবে হ্যাঁ, আমি যে অংশ মানসুখ
করে দেই সেটা ভিন্ন কথা। অতঃপর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ আল্লাহর কাছে
তাঁর বান্দাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় সমস্ত আমল বা কাজ এবং আকীদা বা বিশ্বাস সবই
সুস্পষ্ট। হে নবী (সঃ)! আমি তোমার উপর ভাল কাজ, ভাল কথা, শরীয়তের
হুকুম-আহকাম সহজ করে দিবো। এতে কোন প্রকার সংকীর্ণতা ও কাঠিন্য থাকবে না। থাকবে না কোন প্রকার বক্রতা।
তুমি এমন জায়গায় উপদেশ দাও যেখানে উপদেশ হয় ফলপ্রসূ। এতে বুঝা যায় যে, অযোগ্য
নালায়েকদেরকে শিক্ষাদান করা উচিত নয়। যেমন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “যদি তোমরা কারো
সাথে এমন কথা বল যা তার জন্যে বোধগম্য নয়, তবে তোমাদের কল্যাণকর কথা তার জন্যে অকল্যাণ বয়ে আনবে। তাতে ফিত্না-ফাসাদ সৃষ্টি হবে। বরং মানুষের সাথে তোমরা তাদের বোধগম্য
বিষয়ে কথা বলো, যাতে মানুষ আল্লাহ
ও তাঁর রাসূল (সঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে না পারে।”
এরপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ এই কুরআন থেকে
তারাই নসীহত বা উপদেশ লাভ করবে যাদের অন্তরে আল্লাহ্ ভীতি রয়েছে এবং যারা আল্লাহর
সাথে সাক্ষাতের ভয় মনে পােষণ করে। পক্ষান্তরে, যারা হতভাগ্য তারা এ কুরআন থেকে কোন শিক্ষা বা উপদেশ গ্রহণ করতে পারবে না।
তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। যেখানে কোনরূপ আরাম-আয়েশ ও শান্তি-সুখ নেই, বরং আছে চিরস্থায়ী
আযাব ও নানা প্রকার যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
যারা আসল জাহান্নামী তারা
না মৃত্যুবরণ করবে, না শান্তিপূর্ণ
জীবন যাপন করতে পাবে। তবে যাদের প্রতি আল্লাহ তা'আলা দয়া করার ইচ্ছা রাখেন তারা জাহান্নামের আগুনে পতিত হবার সাথে সাথেই পুড়ে
মারা যাবে। তারপর সুপারিশকারী লোকেরা
গিয়ে তাদের জন্যে সুপারিশ করবেন এবং তাদেরকে জাহান্নাম হতে বের করে এনে
জীবনদানকারী ঝর্ণায় ফেলে দিবেন। তাদের উপর জান্নাতের ঐ ঝর্ণাধারা পানি ঢেলে দেয়া
হবে। ফলে তারা সজীব হয়ে উঠবে যেমনভাবে বন্যায় নিক্ষেপিত বস্তুর (আবর্জনা
স্কুপের) মাঝে বীজ গজিয়ে ওঠে।” তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “তোমরা দেখাে না যে, ঐ উদ্ভিদ প্রথমে
সবুজ হয়, তারপর হলদে হয় এবং
শেষে পূর্ণ সজীবতা লাভ করে থাকে?” তখন সাহাবীদের কোন একজন বললেনঃ “নবীপাক (সঃ) কথাগুলো এমনভাবে
বললেন যে, যেন তিনি জঙ্গলেই
ছিলেন।”৬
আল্লাহ্ তা'আলা জাহান্নামবাসীদের
সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে কুরআন কারীমে বলেছেনঃ
وَنَادَوْا يَا مَالِكُ لِيَقْضِ عَلَيْنَا رَبُّكَ قَالَ
إِنَّكُم مَّاكِثُونَ
অর্থাৎ “জাহান্নামীরা
চীৎকার করে বলবেঃ হে (জাহান্নামের দারোগা) মালিক! আপনার প্রতিপালককে বলুন যে, তিনি যেন আমাদের
মৃত্যু ঘটিয়ে দেন। তখন জবাবে তাদেরকে বলা হবেঃ তোমাদেরকে এখানেই পড়ে থাকতে হবে।” (৪৩ঃ ৭৭) আর এক
জায়গায় আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
তাদের মৃত্যুও ঘটানো হবে না এবং তাদের আযাবও হালকা করা হবে না।" (৩৫ঃ৩৬)এই অর্থ সম্বলিত আরো আয়াত রয়েছে।
--
১৪। নিশ্চয় সেই সাফল্য
লাভ করে যে পবিত্রতা অর্জন করে।
১৫। এবং স্বীয় প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামায আদায় করে।
১৬। কিন্তু তোমরা পার্থিব
জীবনকে পছন্দ করে থাকো।
১৭। অথচ আখেরাতের জীবনই
উত্তম ও অবিনশ্বর।
১৮। নিশ্চয়ই এটা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে (বিদ্যমান) আছে।
১৯। (বিশেষতঃ) ইবরাহীম (আঃ)-ও মুসা (আঃ)-এর
গ্রন্থসমূহে।
--
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ যে ব্যক্তি
চরিত্রহীনতা হতে নিজেকে পবিত্র করে নিয়েছে, ইসলামের হুকুম আহকামের পুরোপুরি তাবেদারী করেছে এবং নামায প্রতিষ্ঠিত করেছে
শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশ পালন ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে, সে মুক্তি ও সাফল্য
লাভ করেছে।
হযরত জাবির ইবনে
আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) قَدْ
أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “যে ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করেছে, সে মুক্তি ও সাফল্য লাভ করেছে।” আর وَذَكَرَ
اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “এটা হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া এবং এর উপর পুরোপুরি যত্নবান থাকা।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)
বলেন যে, এখানে দৈনন্দিনের
পাঁচ ওয়াক্ত নামাযকে বুঝানো হয়েছে।
হযরত আবুল আলিয়া (রঃ)
একবার ঈদের পূর্বের দিন আবূ খালদা (রঃ)-কে বলেনঃ “কাল ঈদগাহে যাওয়ার সময় আমার সাথে সাক্ষাৎ করে যেয়ো।” আবু খালদা’ (রঃ) বলেনঃ আমি তার
কথামত তার কাছে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি কি কিছু খেয়েছো?” আমি উত্তরে বললামঃ হ্যাঁ (খেয়েছি)। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “গোসল করেছো?” আমি জবাব দিলামঃ হ্যাঁ
(করেছি)। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “ফিত্রা’ আদায় করেছো?” আমি জবাবে বললামঃ হ্যাঁ
(করেছি)। তিনি তখন বললেনঃ “আমি তোমাকে এ কথা
বলার জন্যেই ডেকেছিলাম। এ আয়াতের অর্থও এটাই বটে।"
মদীনাবাসী ফিত্রা’ আদায় করা এবং পানিপান করানোর চেয়ে উত্তম কোন সাদকার কথা জানতেন । হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীযও (রঃ) লোকদেরকে ফিত্রা’ আদায়ের আদেশ করতেন
এবং এ আয়াত পাঠ করে শুনাতেন।
হযরত আবুল আহওয়াস (রঃ)
বলতেনঃ “যদি তোমাদের মধ্যে
কেউ নামায পড়ার ইচ্ছা করে এবং এই অবস্থায় কোন ভিক্ষুক এসে পড়ে তবে যেন সে তাকে
কিছু দান করে।” অতঃপর তিনি ' قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى - وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى এই আয়াত দু’টি পাঠ করতেন।
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতদ্বয়ের
ভাবার্থ হলোঃ যে নিজের মালকে পবিত্র করেছে এবং স্বীয় সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট
করেছে (সে সফলকাম হয়েছে)।
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ কিন্তু তোমরা
পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকো। অর্থাৎ তোমরা আখেরাতের উপর পার্থিব জীবনকেই
প্রাধান্য দিচ্ছ, অথচ প্রকৃতপক্ষে
আখেরাতের জীবনকে দুনিয়ার জীবনের উপর প্রাধান্য দেয়ার মধ্যেই তোমাদের কল্যাণ
নিহিত রয়েছে। দুনিয়া তো হলো ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর অমর্যাদাকর। পক্ষান্তরে, আখেরাতের জীবন হলো চিরস্থায়ী ও মর্যাদাকর। কোন বুদ্ধিমান লোক অস্থায়ীকে
স্থায়ীর উপর এবং মর্যাদাহীনকে মর্যাদাসম্পন্নের উপর প্রাধান্য দিতে পারে না।
দুনিয়ার জীবনের জন্যে আখেরাতের জীবনের প্রস্তুতি পরিত্যাগ করতে পারে না।
মুসনাদে আহমদে হযরত
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়া ঐ ব্যক্তির ঘর যার (আখেরাতে কোন) ঘর নেই, দুনিয়া ঐ ব্যক্তির
সম্পদ যার (আখেরাতে কোন) সম্পদ নেই এবং দুনিয়ার জন্যে ঐ ব্যক্তি (মালধন) জমা করে
যার বিবেক বুদ্ধি নেই।”
হযরত আফাজা’ সাকাফী (রাঃ) হতে
বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কাছে سَبِّحِ
اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى এই সূরাটির পাঠ শুনতে চাচ্ছিলাম। যখন তিনি بَلْ
تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا পর্যন্ত পৌঁছলেন তখন তিনি এর পাঠ ছেড়ে দিয়ে স্বীয়
সঙ্গীদেরকে বললেনঃ “আমরা পার্থিব
জীবনকে আখেরাতের জীবনের উপর প্রাধান্য দিয়েছি। তার এ কথায় জনগণ নীরব থাকলে তিনি
বলেনঃ আমরা দুনিয়ার মোহে পড়ে গেছি। দুনিয়ার সৌন্দর্য নারী, খাদ্য ও পানীয় ইত্যাদি আমরা দেখতে
পাচ্ছি। আর আখেরাত আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়েছে। তাই আমরা আমাদের সামনের জিনিসের
প্রতি মনোযোগ দিয়েছি এবং দূরের জিনিস হতে চক্ষু ফিরিয়ে নিয়েছি।”৭ হযরত আবদুল্লাহ
(ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ কথাগুলো বিনয় প্রকাশের জন্যে বলেছেন, না মানুষের স্বভাব
হিসেবে বলেছেন তা আল্লাহ পাকই ভাল জানেন।
মুসনাদে আহমদে হযরত আবু
মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবেসেছে সে তার আখেরাতের ক্ষতি করেছে, আর যে ব্যক্তি
আখেরাতকে ভালবেসেছে, সে তার দুনিয়ার
ক্ষতি করেছে। হে জনমণ্ডলী! যা বাকী থাকবে তাকে যা বাকী থাকবে না তার উপর প্রাধান্য
দাও।”
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “এটা তো পূর্ববর্তী
সহীফাসমূহে ইবরাহীম (আঃ) এবং মূসা (আঃ)-এর সহীফাসমূহে রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস
(রাঃ) বলেন যে, যখন إِنَّ هَذَا لَفِي الصُّحُفِ الْأُولَى - صُحُفِ إِبْرَاهِيمَ
وَمُوسَى এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন নবী করীম (সঃ) বলেনঃ “এর প্রত্যেকটাই
হযরত ইবরাহীম (আঃ)ও হযরত মূসা (আঃ)-এর সহীফাসমূহে বিদ্যমান ছিল।”৮
সুনানে নাসাঈতে হযরত ইবনে
আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন سَبِّحِ
اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى
অবতীর্ণ হয় তখন বলেন “এর প্রত্যেকটাই হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ)-এর সহীফাসমূহে রয়েছে। আর
যখন وَإِبْرَاهِيمَ الَّذِي وَفَّى (৫৩ঃ ৩৭) অবতীর্ণ হয় তখন বলেনঃ হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর দায়িত্ব পুরোপুরি পালন
করেছিলেন। وَلاَ
تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى (কোন বহনকারী অপরের বোঝা
বহন করবে না। (১৭ঃ ১৫) অর্থাৎ এই আয়াত সুরা নাজমের নিম্নের আয়াতগুলোর মতঃ
أَمْ لَمْ يُنَبَّأْ بِمَا فِي صُحُفِ مُوسَى - وَإِبْرَاهِيمَ
الَّذِي وَفَّى - أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى - وَأَن لَّيْسَ
لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَى - وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى - ثُمَّ يُجْزَاهُ
الْجَزَاء الْأَوْفَى - وَأَنَّ إِلَى رَبِّكَ الْمُنتَهَى
অর্থাৎ “তাকে কি অবগত করা
হয়নি যা আছে মূসা (আঃ) এর কিতাবে? এবং ইব্রাহীম (আঃ) এর কিতাবে, যে পালন করেছিল তার দায়ীত্ব? তা এই যে, কোন বহনকারী অপরের বোঝা
বহন করবে না। আর এই যে, মানুষ তাই পায় যা
সে করে। আর এই যে, তার কর্ম অচিরেই
দেখানো হবে। অতঃপর তাকে দেয়া হবে পূর্ণ প্রতিদান। আর এই যে, সবকিছুর সমাপ্তি তো
তোমার প্রতিপালকের নিকট [ শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলো]।" (৫৩ঃ ৩৬-৪২) অর্থাৎ সমস্ত হুকুম-আহকাম পূর্ববর্তী আয়াতসমূহেও লিপিবদ্ধ ছিল।
একইভাবে -
سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى
সূরার আয়াতগুলোতেও ঐ সব হুকুম আহকামের কথা বুঝানো
হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, সমগ্র সূরাটিতেই
এগুলোর বর্ণনা রয়েছে। আবার কারো কারো মতে قَدْ
أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى হতে وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ
وَأَبْقَى পর্যন্ত আয়াতগুলোতে এর বর্ণনা রয়েছে। প্রথম
উক্তিটিই বেশী সবল। এটাকেই হাসান (রঃ) পছন্দ করেছেন। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই
সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
--
(সূরাঃ আ'লা এর তাফসীর সমাপ্ত)
--
❏ টীকাঃ
১. এ হাদীসটি সহীহ মুসলিম, সুনানে আবী দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী এবং
সুনানে ইবনে মাজাহতেও বর্ণিত হয়েছে।
২. এই হাদীসটিও নানাভাবে
বহুসংখ্যক সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তবে, এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
৩. এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজা (রঃ)ও বর্ণনা করেছেন।
৪. এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) ৫. এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৬. এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তাছাড়া এটা বিভিন্ন শব্দে আরো বহু হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
৭. এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৮. এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
No comments:
Post a Comment