দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর
নামে শুরু করছি।
১। প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে।
২। যতক্ষণ না তোমরা সমাধিসমূহে উপস্থিত হচ্ছ।
৩। এটা সংগত নয়, তোমরা শীঘ্রই এটা
জানতে পারবে;
৪। আবার বলি, এটা সংগত নয়, তোমরা শীঘ্রই এটা
জানতে পারবে।
৫। সাবধান! তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহাচ্ছন্ন হতে না।
৬। তোমরা তো জাহান্নাম দেখবেই।
৭। আবার বলি, তোমরা তো ওটা দেখবেই
চাক্ষুষ প্রত্যয়ে,
৮। এরপর অবশ্যই সেইদিন তোমরা সুখ সম্পদ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে।
--
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ দুনিয়ার
প্রতি ভালবাসা, দুনিয়া পাওয়ার
প্রচেষ্টা তোমাদেরকে আখেরাতের প্রত্যাশা এবং সৎকাজ থেকে বেপরোয়া করে দিয়েছে। তোমরা
এ দুনিয়ার ঝামেলাতেই লিপ্ত থাকবে, হঠাৎ মৃত্যু এসে তোমাদেরকে কবরে পৌঁছিয়ে দিবে।
হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বলেছেনঃ “দুনিয়ার সন্ধানে
ব্যাপৃত হয়ে তোমরা আল্লাহর
আনুগত্যের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েছে। এবং মৃত্যুর সময় পর্যন্ত এ উদাসীনতা
অক্ষুন্ন থেকেছে!”
হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, মানুষের ধন সম্পদ ও সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধির লালসা তার মৃত্যুর চিন্তাকে দূরে
নিক্ষেপ করেছে।
সহীহ বুখারী শরীফের কিতাবুর রিকাকে আছে যে, হযরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ) বলেনঃ আমরা এটাকে কুরআনের আয়াত মনে করতাম, (لو كان لابن ادم واد من ذحب) (অর্থাৎ বানী আদমের যদি এক উপত্যকা ভর্তি সোনা থাকে) এটাকে কুরআনের আয়াত মনে
করতাম, এমতাবস্থায় (أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ) এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শুখায়ের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ আমি যখন
নবী করীম (সঃ)-এর দরবারে হাজির হই তখন তিনি এ আয়াত পাঠ করছিলেন। তিনি বলছিলেনঃ “বানী আদম বলছেঃ
আমার, মাল, আমার মাল। অথচ তোমার
মাল শুধু সেগুলো যেগুলো তুমি খেয়ে শেষ করেছে এবং পরিধান করে ছিড়ে ফেলেছে। অথবা সাদকা করে অবশিষ্ট রেখেছো।” ১
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে অতিরিক্ত এ কথাও রয়েছেঃ “এ ছাড়া অন্য যা
কিছু রয়েছে সেগুলো তুমি মানুষের জন্যে রেখে চলে যাবে।”
সহীহ বুখারীতে হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বলেছেনঃ “মৃত ব্যক্তির সাথে
তিনটি জিনিষ যায়, তার মধ্যে দুটি
ফিরে আসে, শুধু একটি সাথে
থেকে যায়। (ওগুলো হলো) আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ এবং আমল। প্রথমোক্ত দুটি ফিরে আসে শুধু আমল সাথে থেকে যায়।”২
মুসনাদে আহমাদে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ)
বলেছেনঃ “আদম সন্তান বৃদ্ধ
হয়ে যায়, কিন্তু দুটি জিনিস
তার সাথে অবশিষ্ট থেকে যায়, লোভ ও আকাঙ্খা।৩
হযরত যহহাক (রঃ) একটি লোকের হাতে একটি দিরহাম দেখে তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “এ দিরহাম কার?” উত্তরে লোকটি বললোঃ “আমার।” তখন হযরত যহহাক
(রঃ)তাকে বললেনঃ “এটা তোমার তখনই হবে
যখন তুমি এটাকে সকাজে অথবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে (আল্লাহর পথে) খরচ করবে।” অতঃপর তিনি
দৃষ্টান্ত স্বরূপ নিম্নের কবিতাংশটি পাঠ করেন।
انت للمال اذا امسكته * فاذا انفقته فا الل لك
অর্থাৎ “যখন তুমি মাল (আল্লাহর পথে খরচ না করে) রুকে রাখবে তখন তুমি হবে তার
মালিকানাধীন। আর যখন তুমি তা খরচ করবে তখন ঐমাল তোমার মালিকানাধীন হয়ে যবে।”৪
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত ইবনে বুরাইদাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এই সূরাটি আনসারের
দু'টি গোত্র বানূ
হারিসাহ্ এবং বানূ হারিসের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। তারা একে অপরের উপর গর্ব প্রকাশ
করতে থাকে। তারা বলেঃ দেখো, আমাদের মধ্যে অমুক
ব্যক্তি এ রকম বাহাদুর, এ রকম অর্থ-সম্পদের
অধিকারী ইত্যাদি। জীবিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে এ রকম গর্ব প্রকাশ করার পর বলেঃ চলো, কবরস্থানে যাই।
সেখানে তারা নিজ নিজ সর্দারের কবরের প্রতি ইশারা করে বলতে শুরু করেঃ বলতো, এর মত তোমাদের
মধ্যে কেউ কি ছিল? মৃত ব্যক্তিদের নাম
নিয়ে নিয়ে তারা নানা অপবাদ দিতে থাকে। এবং তাদেরকে ভৎর্সনা করে। আল্লাহ তায়ালা
তখন এ সূরার প্রথম দু'টি আয়াত অবতীর্ণ
করেন। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে, এমন কি তোমরা কবরে উপনীত হও। অর্থাৎ কবরে উপনীত হয়ে নিজেদের সর্দারদের
ব্যাপারেও গর্ব করতে থাকো। অথচ তোমাদের উচিত ছিল সেখানে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা।
পূর্ব পুরুষদের মরে যাওয়া ও পচে গলে যাওয়ার কথা চিন্তা করে নিজেদের পরিণতি
চিন্তা করা উচিত ছিল।
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ মানুষ নিজের প্রাচুর্যের ব্যাপারে অহংকার করছে। আর একে
একে কবরে গিয়ে প্রবেশ করছে। অর্থাৎ প্রাচুর্যের আকাঙ্ক্ষা তাকে উদাসীনতায়
নিমজ্জিত রেখেছে এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে এবং সমাধিস্থ হয়েছে।
সহীহ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক বেদুইনের মৃত্যুকালে তার পরিচর্যার জন্যে হাজির হলেন এবং
যথা অভ্যাস বললেনঃ “কোন ভয় নেই, ইনশাআল্লাহ তুমি
গুনাহ থেকে পবিত্রতা লাভ করবে।” লোকটি তখন বললোঃ আপনি পবিত্রতা লাভ করার কথা বলছেন, কিন্তু এটা এমন
জ্বর যার প্রকোপ বড়দেরকেও ঘায়েল করে ফেলে এবং কবরে পৌছিয়ে দেয়। তখন
রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “আচ্ছা, তাহলে তোমার কথাই
ঠিক।” এ হাদীসেও (تزيره القبور) শব্দ রয়েছে। আলোচ্য সূরাতেও (زُرْتُمُ
الْمَقَابِرَ) রয়েছে। এর অর্থ হলো
মৃত্যুবরণ করে কবরে উপনীত হওয়া।
জামে তিরমিযীতে হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “এ আয়াত অবতীর্ণ না
হওয়া পর্যন্ত আমরা কবরের আযাব সম্পর্কে সন্ধিহানই ছিলাম।”৫
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে মায়মূন ইবনে মিহরান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা হযরত উমর
ইবনে আবদিল আযীয (রঃ)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলেন। ঐ সময় তিনি (حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ-أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ ) এই আয়াত পাঠ করেন।
তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেনঃ “হে মায়মূন (রঃ)! কবরসমূহ দেখার উদ্দেশ্য হলো যিয়ারত করা, প্রত্যেক
যিয়ারতকারী নিজের জায়গায় ফিরে যায়। অর্থাৎ হয়তো জাহান্নামের দিকে যায়, না হয় জান্নাতের
দিকে যায়।”
একজন বেদুইন এক ব্যক্তির মুখে এ আয়াত দু’টি শুনে বলেছিলঃ “আসল বাসস্থান তো
অন্যত্রই বটে।”
এরপর আল্লাহ তা'আলা হুমকির সুরে দু'দুবার বলেনঃ কখনো নয়, শ্রীঘ্রই তোমরা
জানতে পারবে। আবারও বলিঃ কখনো নয়, অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। এ অর্থও করা হয়েছে যে, প্রথমবার কাফিরদের
উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে এবং দ্বিতীয়বার মু'মিনদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে।
তারপর মহা প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ কখনো নয়, যদি তোমরা নিশ্চিতরূপে অবগত হতে তবে এরূপ দাম্ভিকতার মধ্যে পতিত থাকতে না।
অর্থাৎ মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেদের শেষ মনযিল আখেরাত সম্পর্কে উদাসীন থাকতে
না। এরপর প্রথমোক্ত বিষয়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেছেনঃ তোমরা তো জাহান্নাম
দেখবেই। সেই জাহান্নামের ভয়াবহতা এক নযর দেখেই ভয়ে-ভীতিতে অন্যেরা তো বটেই, আম্বিয়ায়ে কিরামও
হাঁটুর ভরে পড়ে যাবেন।
ওর কাঠিন্য ও ভীতি প্রত্যেকের অন্তরে ছেয়ে যাবে। এ
সম্পর্কে বহু হাদীসে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ এরপর
অবশ্যই সেইদিন তোমাদেরকে নিয়ামত সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হবে। স্বাস্থ্য, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য
নিরাপত্তা, রিহ্যাক ইত্যাদি
সকল নিয়ামত সম্বন্ধেই প্রশ্ন করা হবে। এসব নিয়ামতের কতটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা
হয়েছে তা জিজ্ঞেস করা হবে।
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব
(রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা ঠিক দুপুরে
রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ঘর হতে বের হন। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখেন যে, হযরত আবূ বকর
(রাঃ)ও মসজিদের দিকে আসছেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ এ সময়ে বের হলে
কেন?” উত্তরে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ “যে কারণ আপনাকে ঘর হতে বের করেছে ঐ একই কারণ আমাকেও ঘর হতে বের করেছে।” ঐ সময়ে হযরত উমর
(রাঃ)ও এসে তাদের সাথে মিলিত হন। তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “এই সময়ে বের হলে
কেন?” তিনি জবাবে বললেনঃ “যে কারণ আপনাদের দু'জনকে বের করেছে ঐ
কারণই আমাকেও বের করেছে।” এরপর রাসূলুল্লাহ্
(সঃ) তাঁদের সাথে আলাপ শুরু করলেন। তিনি তাদেরকে বললেনঃ “সম্ভব হলে চলো, আমরা ঐ বাগান
পর্যন্ত যাই। ওখানে আহারেরও ব্যবস্থা হবে এবং ছায়াদানকারী জায়গাও পাওয়া যাবে।
তারা বললেন, “ঠিক আছে, চলুন।” অতঃপর রাসুলুল্লাহ
(সঃ) তাঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে আবুল হায়সাম (রাঃ) নামক সাহাবীর বাগানের দরজায় উপনীত
হলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) দরজায় গিয়ে সালাম জানালেন এবং ভিতরে প্রবেশের অনুমতি
চাইলেন। উম্মে হায়সাম দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু উচ্চস্বরে
জবাব দিচ্ছিলেন না। তিনি আল্লাহ্র রাসূল (সঃ)-এর নিকট থেকে শান্তির দু’আ বেশী পরিমানে পাওয়ার লোভেই
এ নীরবতা পালন করছিলেন। তিনবার সালাম জানিয়েও কোন জবাব না পেয়ে রাসূলুল্লাহ্
(সঃ) সঙ্গীদ্বয়সহ ফিরে আসতে উদ্যত হলেন। এবার উম্মে হায়সাম (রাঃ) ছুটে গিয়ে
বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল
(সঃ)! আপনার আওয়ায আমি শুনছিলাম, কিন্তু আপনার সালাম বেশী বেশী পাওয়ার লোভেই উচ্চস্বরে জবাব দেইনি। এখন আপনি
চলুন।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)
হযরত উম্মে হায়সাম (রাঃ)-এর এ ব্যবহারে বিরক্ত হলেন না। জিজ্ঞেস করলেনঃ “আবু হায়সাম (রাঃ)
কোথায়?” উম্মে হায়সাম (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ “তিনি নিকটেই আছেন, পানি আনতে গেছেন।
এক্ষুণি তিনি এসে পড়বেন, আপনি এসে বসুন!” রাসূলুল্লাহ্ (রাঃ)
এবং তাঁর সঙ্গীদ্বয় বাগানে প্রবেশ করলেন। উম্মে হায়সাম (রাঃ) ছায়া দানকারী একটি
গাছের তলায় কিছু বিছিয়ে দিলেন। রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সঙ্গীদ্বয়কে সেখানে
উপবেশন করলেন। ইতিমধ্যে আবু হায়সামও (রাঃ) এসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এবং তার
সঙ্গীদ্বয়কে দেখে তাঁর আনন্দের কোন সীমা থাকলো না। এতে তিনি মানসিক শান্তি লাভ
করলেন। তাড়াতাড়ি একটা খেজুর গাছে উঠলেন এবং ভাল ভাল খেজুর পাড়তে লাগলেন।
রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) নিষেধ করার পর থামলেন এবং নেমে এলেন। এসে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল
(সঃ)! কাঁচা, পাকা, শুকনো, সিক্ত ইত্যাদি সব
রকম খেজুরই রয়েছে। যেটা ইচ্ছা ভক্ষণ করুন।” তাঁরা ওগুলো ভক্ষণ করলেন। তারপর মিষ্টি ও ঠাণ্ডা পানি দেয়া হলো। তাঁরা সবাই পান করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এই নিয়ামত
সম্পর্কে তোমাদেরকে আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞেস করা হবে।”৬
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ হাদীসটি নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেনঃ
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উমার (রাঃ) এসেছিলেন এমন সময় রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)
তাঁদের কাছে এলেন এবং বললেনঃ “এখানে বসে আছ কেন?” উত্তরে তারা বললেনঃ “যিনি আপনাকে সত্যসহ
প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! ক্ষুধা আমাদেরকে ঘর হতে বের করে এনেছে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)
তখন বললেনঃ “যিনি আমাকে সত্যসহ
প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! ক্ষুধা আমাকেও বের করে এনেছে।” তারপর রাসূলুল্লাহ্
(সঃ) ঐ দুই সাহাবী (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে এক আনসারীর বাড়িতে গেলেন। আনসারী বাড়িতে
ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আনসারীর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার স্বামী
কোথায়?” মহিলা উত্তরে বললেনঃ “তিনি আমাদের জন্যে
মিষ্টি পানি আনতে গেছেন। ইতিমধ্যে ঐ আনসারী পানির মশক নিয়ে এসেই পড়লেন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে দেখে আনসারী আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন।
তিনি বললেনঃ “আমার বাড়িতে আজ
আল্লাহর রাসূল (সঃ) তাশরীফ এনেছেন, সুতরাং আমার মত ভাগ্যবান আর কেউ নেই।” পানির মশক ঝুলিয়ে রেখে আনসারী বাগানে গিয়ে তা তা খেজুরের কাদি নিয়ে আসলেন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ বেছে বেছে আনলেই তো হতো?” আনসারী বললেনঃ “ভাবলাম যে, আপনি পছন্দ মত
বাছাই করে গ্রহণ করবেন। তারপর (একটা বকরী বা মেষ যবাহ্ করার জন্যে) আনসারী একটি
ছুরি হাতে নিলেন। রাসূলুল্লাহ্ বললেনঃ “দেখো, দুগ্ধবতী (কোন বকরী
বা মেষ) যবাহ করো না।” অতঃপর আনসারী তাদের
জন্যে (কিছু একটা) যবাহ করলেন এবং তারা সেখানে আহার করলেন। তারপর তিনি সাহাবীদেরকে
লক্ষ্য করে বললেনঃ “দেখো, ক্ষুধার্ত অবস্থায়
তোমরা ঘর থেকে বেরিয়েছিলে, অথচ এখন পেট পূর্ণ
করে ফিরে যাচ্ছ। এই নিয়ামত সম্পর্কে তোমরা কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।”
রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর আযাদকৃত দাস হযরত আবু উসায়েব (রাঃ) বলেনঃ “একদা রাসূলুল্লাহ্
(সঃ) আমার পার্শ্ব দিয়ে গমন করে আমাকে ডাক দেন। তারপর হযরত আবূ বকর (রাঃ) ও হযরত
উমার (রাঃ)-এর পার্শ্ব দিয়ে গমন করেন এবং তাদেরকেও ডেকে নেন। তারপর এক আনসারীর
বাগানে গিয়ে বললেনঃ “দাও ভাই, খেতে দাও।” আনসারী তখন এক
গুচ্ছ আঙ্গুর এনে দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এবং সঙ্গীরা তা ভক্ষণ করলেন। তারপর
রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আনসারীকে বললেনঃ “ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এসো।” আনসারী পানি এনে
দিলে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এবং তাঁর সঙ্গীরা তা পান করলেন। তারপর নবীকরীম (সঃ) বললেনঃ “কিয়ামতের দিন এ
সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”এ কথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) খেজুর গুচ্ছ উঠিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে বললেনঃ “এ সম্পর্কেও
জিজ্ঞাসিত হতে হবে?” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা। তবে তিনটি জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। তা হলো সম্ভ্রম
রক্ষার উপযোগী পোশাক, ক্ষুধা নিবৃত্তির
উপযোগী খাদ্য এবং শীত-গ্রীষ্ম থেকে রক্ষা পাওয়ার উপযোগী গৃহ।”৭
হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ
(সঃ) হযরত আবূ বকর (রাঃ) এবং হযরত উমার (রাঃ) খেজুর ভক্ষণ করেন ও পানি পান করেন।
তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এই নিয়ামত সম্বন্ধে তোমরা অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে।”৮
হযরত মাহমুদ ইবনে রাবী হতে বর্ণিত আছে যে, যখন (أَلْهَاكُمُ
التَّكَاثُرُ) এ সূরা অবতীর্ণ হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে এটা পাঠ করে শুনান। যখন তিনি (لَتُسْأَلُنَّ
يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ) পর্যন্ত পৌঁছেন তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কোন নিয়ামত সম্বন্ধে আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে? খেজুর খাচ্ছি, পানি পান করছি, ঘাড়ের উপর তরবারী
ঝুলছে, শত্রু শিয়রে
দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং আমরা কোন নিয়ামত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবো?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “ভয় করো না, শীঘ্রই নিয়ামত এসে
পৌঁছবে।”৯
মুআয ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে হাবীব (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে
এবং তিনি তাঁর চাচা হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি (তাঁর চাচা) বলেনঃ “আমরা এক মজলিসে
বসেছিলাম এমন সময় নবী করীম (সঃ) আমাদের নিকট আগমন করলেন, তাঁর মাথায় পানির
চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল (তিনি গোসল করে এসেছেন বলে মনে হচ্ছিল)। আমরা বললামঃ হে
আল্লাহর রাসুল (সঃ)! আপনাকে তো বেশ আনন্দিত চিত্ত মনে হচ্ছে? তিনি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, তাই।” তারপর “গিনা বা ধন ঐশ্বর্য
সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যার অন্তরে আল্লাহ ভীতি রয়েছে তার জন্যে “গিনা বা ধন সম্পদ খারাপ জিনিষ নয়। মনে রেখো, পরহেযগার ব্যক্তির জন্যে সুস্থতা গিনার চেয়েও উত্তম। আনন্দ চিত্ততাও আল্লাহ
তা'আলার নিয়ামত।”১০
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ “নিয়ামতের প্রশ্নে
কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথমে বলা হবেঃ “আমি কি তোমাকে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা দান করিনি? ঠাণ্ডা পানি দিয়ে তোমাকে কি পরিতৃপ্ত করিনি?”
হযরত ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন (ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ) এ আয়াত অবতীর্ণ হলো তখন
সাহাবীগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল
(সঃ)! আমরা কি এমন নিয়ামত ভােগ করছি যে, সে সম্বন্ধে আমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে? আমরা তো যবের রুটি ভক্ষণ করছি, (তাও পেট পুরে নয়, বরং) অর্ধভুক্ত
থেকে যাচ্ছি?” তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী (সঃ) এর কাছে অহী পাঠালেনঃ তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ তোমরা
কি (পায়ের আরামের জন্যে) জুতা পরিধান কর না এবং (তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে) ঠাণ্ডা
পানি পান কর না? এই নিয়ামতগুলো
সম্পর্কেই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে।১১ অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, শান্তি, নিরাপত্তা এবং
সুস্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।
পেট পুরে আহার করা, ঠাণ্ডা পানি পান
করা ছায়াদানকারী ঘরে বাস করা, আরামদায়ক ঘুম যাওয়া, আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ
করা, এমনকি মধু পান করা, সকাল বিকাল আহার
করা, ঘি, মধু, ময়দার রুটি
ইত্যাদি সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেনঃ শারীরিক সুস্থতা, কান চোখের সুস্থতা
ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবেঃ তোমরা এ । সবকে কি কাজে ব্যবহার করেছো? যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ
أُولـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً
অর্থাৎ “কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় ওগুলোর
প্রত্যেকটির সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।" (১৭ঃ ৩৬)
সহীহ বুখারী, সুনানে তিরমিযী, সুনানে নাসাঈ এবং
সুনানে ইবনে মাজাহতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)
বলেছেনঃ
“দু'টি নিয়ামত
সম্পর্কে মানুষ খুবই উদাসীনতার মধ্যে রয়েছে। ও দু'টি নিয়ামত হলো স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছলতা। অর্থাৎ মানুষ এ দুটোর পূর্ণ কৃতজ্ঞতা ও
প্রকাশ করে না এবং এদুটোর শ্রেষ্ঠত্ব এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও অবগত নয়। আল্লাহর
সন্তুষ্টির পথে এ দুটি ব্যয় করে না। উল্লেখ্য যে, সম্ভ্রম রক্ষার উপযোগী পোশাক, ক্ষুধা নিবৃত্তির উপযোগী আহার এবং শীত গ্রীষ্ম হতে রক্ষা পাওয়ার গৃহ ছাড়া
অন্য সবকিছু সম্পর্কেই কিয়ামতের দিন হিসাব দিতে হবে।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ)
বলেছেনঃ মহামহিমান্বিত আল্লাহ কিয়ামতের দিন বলবেনঃ “হে আদম সন্তান! আমি তোমাকে ঘোড়ায় ও উষ্ট্রে আরোহণ করিয়েছি, নারীদের সাথে বিয়ে
দিয়েছি। তোমাকে হাসি খুশীভাবে আনন্দ উজ্জল জীবন যাপনের সুযোগ দিয়েছি। এবার বল তো, এগুলোর জন্যে
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কোথায়?”
(সূরাঃ তাকাসুর এর তাফসীর সমাপ্ত)
---
❏ টীকাঃ
১, এ হাদীসটি বর্ণনা
করেছেন ইমাম আহমাদ (রঃ)।
২. এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈও (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
৩. ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এ হাদীসটি
তাখরীজ করেছেন।
৪. এটা ইবনে আসাকির (রঃ)
বর্ণনা করেছেন।
৫. এ হাদীসটি উসূলে হাদীসের পরিভাষায় গারীব বা দুর্বল।
৬. এ ধারায় এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল।
৭. এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ
(রাঃ) বর্ণনা করেছেন।
৮. এ হাদীসটিও মুসনাদে
আহমাদে বর্ণিত হয়েছে।
৯. ইমাম আহমাদ (রঃ) এর
হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
১০. এ হাদীসটিও
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে। সুনানে ইবনে মাজাহতেও এ হাদীসটি রয়েছে।
১১. এ হাদীসটি ইমাম
ইবনে আবী হাতিম (রঃ) করেছেন।
No comments:
Post a Comment