সূরাঃ গাশিয়াহ/৮৮, মাক্কী | (আয়াতঃ ২৬, রুকূঃ ১)



হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত এ হাদীসটি পূর্বে গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঈদের নামাযে এবং জুমআর দিনে سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى  এবং  الْغَاشِيَةِ পাঠ করতেন।
ইমাম মালিক (রঃ) এর মুআত্তা নামক হাদীস গ্রন্থে রয়েছে যে, জুমআর নামাযে রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রথম রাকআতে সুরা জুমআহ্ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরাهَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ الْغَاشِيَةِ  পাঠ করতেন।
--
করুণাময়, কৃপানিধান আল্লাহর নামে শুরু করছি।
১। তোমার কাছে কি  সমাচ্ছন্নকারীর সংবাদ এসেছে?
২। সে দিন বহু আনন অবনত হবে;
৩। কর্মক্লান্ত পরিশ্রান্তভাবে;
৪। তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত অগ্নিতে;
৫। তাদেরকে উত্তপ্ত প্রস্রবণ হতে পান করানো হবে;
৬। তাদের জন্যে বিষাক্ত কন্টক ব্যতীত খাদ্য নেই;
৭। যা তাদেরকে পুষ্ট করবে না এবং তাদের ক্ষুধাও নিবৃত্ত করবে না।
--
গাশিয়াহ্ হলো কিয়ামতের একটি নাম, কারণ এটা সবার উপর আসবে, সবাইকে ঘিরে ধরবে এবং ঢেকে ফেলবে। মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত আমর ইবনে মায়ুমুন (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) একটি স্ত্রী লোকের পার্শ্ব দিয়ে গমন করার সময় শুনতে পান যে, هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ الْغَاشِيَةِ  পাঠ করছে। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গিয়ে শুনতে থাকেন এবং বলেনঃ نعم قد خاءنى  ' অর্থাৎহ্যাঁ, আমার নিকট (কিয়ামতের সংবাদ) এসেছে।

এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ সেইদিন বহু লোক হবে অপমানিত চেহারাবিশিষ্ট। অবমাননা তাদের উপর আপতিত হবে। তাদের পুণ্যকর্মসমূহ বিনষ্ট হয়ে যাবে। তারা বড় বড় কাজ করেছিল, আমলের জন্যে কষ্ট করেছিল, কিন্তু আজ তারা প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করবে।

হযরত আবু ইমরান জাওফী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (র) এক রাহিবের (খ্রিষ্টান পাদ্রীর) আশ্রমের পার্শ্ব দিয়ে গমন করছিলেন। সেখা গড়িয়ে তিনি ঐ রাহিবকে ডাক দেন। খ্রিস্টান সাধক তাঁর কাছে হাজির হতে সাধককে দেখে কেঁদে ফেলেন। সাধক তাঁকে ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃআল্লাহ তা'আলার কিতাবে উল্লেখিত তাঁর   عَامِلَةٌ نَّاصِبَةٌ - تَصْلَى نَارًا حَامِيَةً -এই উক্তি আমার স্মরণে এসেছে এবং ওটাই আমাকে কাঁদিয়েছে। এর ভাবার্থ হলোঃ ইবাদত, রিয়াযত করছে, অথচ শেষ পর্যন্ত জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ  عَامِلَةٌ نَّاصِبَةٌ দ্বারা খ্রিষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। ইকরামা (রাঃ) এবং সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ দুনিয়ায় তারা পাপের কাজ করছে এবং আখেরাতে তারা শাস্তি এবং প্রহারের কষ্ট ভোগ করবে।

তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত অগ্নিতে। সেখানে ضريع ছাড়া অন্য কোন খাদ্য মিলবে না। এটা হবে আগুনের বৃক্ষ, জাহান্নামের পাথর। এতে বিষাক্ত কন্টক বিশিস্ট ফল ধরে থাকবে। এটা হবে দুর্গন্ধময় খাদ্য ও অত্যন্ত নিকৃষ্ট আহার্য। এটা ভক্ষণে দেহও পুষ্ট হবে না, ক্ষুধাও নিবৃত্ত হবে না এবং অবস্থারও কোন পরিবর্তন হবে না।
--
৮। বহু মুখমণ্ডল হবে সেদিন  আনন্দোজ্জ্বল,
নিজেদের কর্ম সাফল্যে পরিতৃপ্ত,
১০। সমুন্নত, কাননে অবস্থিত হবে।
১১। সেথায় তারা অবান্তর বাক্য  শুনবে না,
১২। সেখানে আছে প্রবহমান  সমালা,
১৩। তন্মধ্যে রয়েছে সমুচ্চ আসনসমূহ
১৪। এবং সুরক্ষিত পান পাত্রসমূহ
১৫। ও সারিসারি উপাধান সমূহ;
১৬। এবং সম্প্রসারিত  গালিচাসমূহ।
--
এর পূর্বে পাপী, দুষ্কৃতিকারী এবং মন্দ লোকদের বর্ণনা এবং তাদের শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ এখানে পুণ্যবান ও সৎকর্মশীলদের পরিণাম ও পুরস্কারের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন যে, সেইদিন এমন বহু চেহারা দেখা যাবে যাদের চেহারা থেকে তৃপ্তি ও আনন্দ উল্লাসের নিদর্শন প্রকাশ পাবে তারা নিজেদের সৎকাজের বিনিময় দেখে খুশী হবে। জান্নাতের উঁচু উঁচু অট্টালিকায় তারা অবস্থান করবে। সেখানে কোন প্রকারের বাজে কথা ও অশ্লীল আলাপ থাকবে না। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ- كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ
সেথায় তারা শুনবে না কোন অসার অথবা পাপ বাক্য” (৫৬ঃ ২৫-২৬)সালাম আর সালামবানী ব্যতীত।আর এক জায়গায় বলেন :
يَتَنَازَعُونَ فِيهَا كَأْسًا لَّا لَغْوٌ فِيهَا وَلَا تَأْثِيمٌ
অর্থাৎতথায় নেই কোন অসার কথা পাপবাক্য।” (৫২ঃ ২৩)।

মহান আল্লাহ বলেনঃসেথায় থাকবে বহমান প্রস্রবণ।' এখানে একটি ঝর্ণার কথা বুঝানো হয়নি। বরং ঝর্ণা সমূহের কথা বুঝানো হয়েছে।

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃজান্নাতের ঝর্ণাসমূহ মিশক এর পাহাড় এবং মিশকের টিলা হতে প্রবাহিত হবে। তথায় থাকবে উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন শয্যা। অর্থাৎ জান্নাতীদের জন্যে জান্নাতে উঁচু উঁচু পালঙ্ক রয়েছে এবং ঐ সব পালঙ্কে উঁচু উঁচু আরামদায়ক বিছানা তোষকসমূহ রয়েছে। সেই বিছানার পাশে হুরগণ বসে আছে। এ সব বিছানাগুলো উঁচু উঁচু গদিবিশিষ্ট হলেও যখনই আল্লাহর বন্ধুরা ওগুলোতে শোবার ইচ্ছা করবে তখন ওগুলো অবনত হয়ে যাবে এবং নুয়ে পড়বে। রকমারী সুরা থাকবে, যে রম সুরা যতটুকু পরিমাণ ইচ্ছা করবে পান করতে পারবে। সারি সারি পালঙ্ক ও ছানা সুসজ্জিত থাকবে, যখন যেখানে খুশী উপবেশন ও শয়ন করতে পারবে।

হযরত উসমান বিন যায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃকেউ আছে কি যে জান্নাতের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে? এমন জান্নাত যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বেহিসাব। কাবার প্রতিপালকের শপথ! সেটা এক চমকিত নুর বা জ্যোতি, সেটা এক উপচে পড়া সবুজ সৌন্দর্য, সেখানে উঁচু উঁচু মহল ও বালাখানা রয়েছে। রয়েছে প্রবাহিত ঝর্ণাধারা, রেশমী পোশাক, নরম নরম গালিচা এবং পাকা পাকা উন্নত মানের ফল। সেটা চিরস্থায়ী স্থান, আরাম আয়েশ ও নিয়ামতে পরিপূর্ণ।" তখন সাহাবীগণ বলে উঠলেনঃআমরা সবাই এ জান্নাতের আকাংখী এবং আমরা এর জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করবো" রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদের একথা শুনে বললেন! ইনশাআল্লাহ (যদি আল্লাহ চান) বল।তখন তারা ইনশাআল্লাহ বললেন।"
--
১৭। তবে কি তারা উষ্ট্রপালের দিকে লক্ষ্য করে না যে,   কিভাবে ওকে সৃষ্টি করা
হয়েছে
১৮। এবং আকাশের দিকে যে,  কিভাবে ওটাকে সমুচ্চ করা হয়েছে?
১৯। এবং পর্বতমালার দিকে যে,  কিভাবে ওটাকে স্থাপন করা হয়েছে?
২০। এবং ভূতলের দিকে যে, কিভাবে ওটাকে সমতল করা হয়েছে?
২১। অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো, তুমি তো একজন উপদেশ দাতা মাত্র।
২২। তুমি তাদের কর্ম নিয়ন্ত্রক নও।
২৩। তবে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে ও কুফরী করলে
২৪ আল্লাহ তাকে কঠোর দন্ডে  দণ্ডিত করবেন।
২৫। নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট।
২৬। অতঃপর আমার উপরই তাদের হিসাব নিকাশ গ্রহণের ভার।
--
আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদেরকে আদেশ করছেন যে, তারা যেন তাঁর সৃষ্টি জগতের বিভিন্ন সৃষ্টির প্রতি গভীর মনোযোগের সাথে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে এবং অনুভব করে যে, ঐ সব থেকে স্রষ্টার কি অপরিসীম ক্ষমতাই না প্রকাশ পাচ্ছে। তার কুদরত, তার ক্ষমতা প্রতিটি জিনিস কিভাবে প্রকাশ করছে। তাই মহান আল্লাহ বলেনঃ তবে কি তারা দৃষ্টিপাত করে না উটের দিকে যে, কিভাবে ওকে সৃষ্টি করা হয়েছে? অর্থাৎ উটের প্রতি গভীর মনোযোগের সাথে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে, ওকে অদ্ভুতভাবে এবং শক্তি ও সুদৃঢ়ভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও এই জন্তু অতি নম্র ও সহজভাবে বোঝা বহন করে থাকে এবং অত্যন্ত আনুগত্যের সাথে চলাফেলা করে। মানুষ ওর গোশত ভক্ষণ করে, ওর পশম তাদের কাজে লাগে, তারা ওর দুধ পান করে থাকে এবং ওর দ্বারা তারা আরো নানাভাবে উপকৃত হয়। সর্বাগ্রে উটের কথা বলার কারণ এই যে, আরবের লোকেরা সাধারণতঃ উটের দ্বারাই সবচেয়ে বেশী উপকৃত হয়ে থাকে। উট আরববাসীদের নিকট সর্বাধিক ব্যবহৃত প্রাণী।

কাযী শুরাইহ (রঃ) বলতেনঃ চলো, গিয়ে দেখি উটের সৃষ্টি নৈপুণ্য কিরূপ এবং আকাশের উচ্চতা জমীন হতে কিরূপ! যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
أَفَلَمْ يَنظُرُوا إِلَى السَّمَاء فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَاهَا وَزَيَّنَّاهَا وَمَا لَهَا مِن فُرُوجٍ
অর্থাৎ তারা কি তাদের উধ্বস্থিত আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না যে, আমি কিভাবে ওটা নির্মাণ করেছি এবং ওকে সুশোভিত করেছি, আর তাতে কোন ফাটল নেই?” (০ঃ৬)।

এরপর বলা হচ্ছেঃ আর তারা কি দৃষ্টিপাত করে না পর্বতমালার দিকে যে, কিভাবে আমি ওটাকে স্থাপন করেছি? অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা পর্বতমালাকে এমনভাবে মাটির বুকে প্রােথিত করে দিয়েছেন, যাতে জমিন নড়াচড়া করতে না পারে। আর পর্বতও যেন অন্যত্র সরে যেতে সক্ষম না হয়। তারপর পৃথিবীতে যেসব উপকারী কল্যাণকর জিনিস সৃষ্টি করেছেন সেদিকেও মানুষের দৃষ্টিপাত করা উচিত। আর জমিনের দিকে তাকালে তারা দেখতে পাবে যে, আল্লাহ তা'আলা কিভাবে ওটাকে বিছিয়ে দিয়েছেন! মোটকৃথা এখানে এমন সব জিনিসের কথা বলা হয়েছে যেগুলো কুরআনের প্রথম ও প্রধান সম্বােধন স্থল আরববাসীদের চোখের সামনে সব সময় থাকে। একজন বেদুঈন যখন তার উটের পিঠে সওয়ার হয়ে বেরিয়ে পড়ে তখন তার পায়ের তলায় থাকে জমীন, মাথার উপর থাকে আসমান, পাহাড় থাকে তার চোখের সামনে, সে নিজের উটের পিঠে আরোহীরূপে থাকে। এ সব কিছুতে স্রষ্টার সীমাহীন কুদরত, শিল্প নৈপুণ্য সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। আরো প্রতীয়মান হয় যে, স্রষ্টা ও প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কেউ নেই যার কাছে নত হওয়া যায়, অনুনয় নিয় ব্রা যায়। আমরা যাকে বিপদের সময় স্মরণ করি, যার নাম জপি যার কাছে মাথানত করি তিনি একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বল আলামীন। তিনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কেউ নেই। হযরত যিমাম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে যে সব প্রশ্ন করেছিলেন সেগুলো এরকম কসম দিয়েই করেছিলেন।

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে বারবার প্রশ্ন করা আমাদের জন্যে নিষিদ্ধ হওয়ার পর আমরা মনে মনে কামনা করতাম যে, যদি বাইরে থেকে কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে আমাদের উপস্থিতিতে প্রশ্ন করতেন তবে তাঁর মুখের জবাব আমরাও শুনতে পেতাম (আর এটা আমাদের জন্য খুব খুশীর বিষয় হতো)! আকস্মিকভাবে একদিন এক দূরাগত বেদুঈন এসে রাসূলুল্লাহকে প্রশ্ন করলেনঃ হে মুহাম্মদ (সঃ)! আপনার দূত আমাদের কাছে গিয়ে বলেছেন যে, আল্লাহ আপনাকে রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন একথা নাকি আপনি বলেছেন?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃসে সত্য কথাই বলেছে।" লোকটি প্রশ্ন করলোঃআচ্ছা, বলুন তো, আকাশ কে সৃষ্টি করেছেন? রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃআল্লাহ।" লোকটি বললোঃজমীন সৃষ্টি করেছেন কে? তিনি উত্তর দিলেনঃআল্লাহ।সে প্রশ্ন করলোঃএই পাহাড়গুলো কে স্থাপন করেছেন এবং তাতে যা কিছু করার তা করেছেন তিনি কে? তিনি জবাব দিলেনঃআল্লাহ।লোকটি তখন বললোঃআসমান জমীন যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং পাহাড়গুলো যিনি স্থাপন করেছেন তাঁর শপথ। ঐ আল্লাহই কি আপনাকে তাঁর রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃহ্যাঁলোকটি প্রশ্ন করলোঃআপনার দূত একথাও বলেছেন যে, আমাদের উপর দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয (এটা কি সত্য)?” তিনি জবাবে বললেনঃহ্যাঁ”, সে সত্য কথাই বলেছে।লোকটি বললোঃযে আল্লাহ আপনাকে রাসুলরূপে পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ! ঐ আল্লাহ কি আপনাকে এর নির্দেশ দিয়েছেন?” তিনি জবাব দিলেনহ্যাঁলোকটি বললোঃআপনার  ‍দূত একথাও বলেছেন যে, আমাদের উপর আমাদের মালের যাকাত রয়েছে। (একথাও কি সত্য)?” তিনি উত্তরে বললেনঃহ্যাঁ, সে সত্যই বলেছে।লোকটি বললোঃযে আল্লাহ আপনাকে প্রেরণ করেছেন তার কসম! তিনিই কি আপনাকে এ নির্দেশ দিয়েছে?” তিনি জবাবে বললেনহ্যাঁলোকটি বললোঃআপনার দূত আমাদেরকে এখনও দিয়েছেন যে, আমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তারা যেন হজ্জব্রত পালন করে (এটাও কি সত্য?)” তিনি জবাব দিলেনঃসে সত্য কথা বলেছে।অতঃপর লোকটি যেতে লাগলোযাওয়ার পথে সে বললো!যে আল্লাহ আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! আমি এগুলোর উপর কমও করবো না, বেশিও করবো না।" তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ!লোকটি যদি সত্য কথা বলে থাকে তবে অবশ্যই সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, লোকটি বললোঃআমি হলাম যিমাম ইবনে সা'লাবাহ্, বানুসাদ ইবনে বকর (রাঃ)-এর ভাই। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে প্রায়ই বলতেনঃজাহেলিয়াতের যুগে এক পাহাড়ের চূড়ায় একটি নারী বসবাস করতোতার সাথে তার এক ছােট সন্তান ছিলঐ নারী বকরী মেষ চরাতোএকদিন ছেলেটি তার মাকে বললোঃআম্মা! তোমাকে কে সৃষ্টি করেছেন?” মহিলাটি উত্তর দিলোঃআল্লাহ।ছেলেটি বললোঃআমার আব্বাকে সৃষ্টি করেছেন কে?" মা জবাব দিলোঃআল্লাহ।ছেলেটি প্রশ্ন করলোঃআমাকে কে সৃষ্টি করেছেন?” মহিলাটি উত্তর দিলোঃআল্লাহ।ছেলেটি জিজ্ঞেস করলোঃপাহাড়গুলো সৃষ্টি করেছেন কে?" মা জবাবে বললোঃআল্লাহ।ছেলে প্রশ্ন করলোঃএই বকরীগুলো কে সৃষ্টি করেছেন?” মা জবাব দিলোঃআল্লাহ।ছেলেটি হঠাৎ বলে ফেললোঃআল্লাহ কতই না মহিমাময়।অতঃপর সে (আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমার কথা চিন্তা করে নিজেকে সম্বরণ করতে না পেরে) পর্বত চূড়া হতে নিচে পড়ে গেল এবং টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি উপদেশ দাও, তুমি তো শুধু একজন উপদেশ দাতা। তুমি তাদের কর্ম নিয়ন্ত্রক নও। অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! তুমি মানুষের কাছে যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছে। তা তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দাও। তোমার দায়িত্ব শুধু পৌঁছিয়ে দেয়া, হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব আমার। এ জন্যেই আল্লাহ তা'আলা বলেনঃতুমি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও।' হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ তুমি তাদের উপর জোর জবরদস্তিকারী নও অর্থাৎ তাদের ন্তরে ইন্ধন সৃষ্টি করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি তাদেরকে ঈমান আনয়নে করতে পারবে না।

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনআমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। যখন তারা এটা বলবে তখন তারা তাদের জানমাল আমা হতে রক্ষা করতে পারবে, ইসলামের হক ব্যতীত (যেমন ইসলাম গ্রহণের পরেও কাউকে হত্যা করলে কিসাস বা প্রতিশোধ হিসেবে তাকে হত্যা করা হবে)। তাদের হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব আল্লাহ তা'আলার উপর থাকবে।" অতঃপর তিনি পাঠ করেনঃ
فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنتَ مُذَكِّرٌ- لَّسْتَ عَلَيْهِم بِمُصَيْطِرٍ
অর্থাৎ অতএব তুমি উপদেশ দাও, তুমি তো একজন উপদেশ দাতা। তুমি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও।"

মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তবে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে ও কুফরী করলে, যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّى- وَلَكِن كَذَّبَ وَتَوَلَّى
অর্থাৎসে বিশ্বাস করেনি ও নামায আদায় করেনি, বরং সে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।" (৭৫ঃ৩১-৩২) এ জন্যেই আল্লাহ পাক বলেন, 'আল্লাহ তাকে দিবেন মহাশাস্তি।

মুসনাদে আহমদে হযরত আবু উমামা আল বাহিলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত খালিদ ইবনে ইয়াযীদ ইবনে মুআবিয়ার (রাঃ) নিকট গমন করে তার কাছে সহজ হাদীস শুনতে চান যা তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হতে শুনেছেন। তখন তিনি বলেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে বলতে শুনেছেন।তোমাদের মধ্যে সবাই জান্নাতে প্রবেশ করবে, শুধু ঐ ব্যক্তি প্রবেশ করবে না যে ঐ দুই উটের ন্যায় যে তার মালিকের সাথে হঠকারিতা করে।

এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ নিশ্চয় তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট। অতঃপর তাদের হিসাব নিকাশ আমারই কাজ। আমি তাদের কাছে হিসাব নিকাশ গ্রহণ করবো এবং বিনিময় প্রদান করব। পুণ্যের জন্যে পুরস্কার দিবো এবং পাপের জন্যে দিবো শাস্তি।
--
(সুরাঃ গাশিয়াহ এর তাফসীর সমাপ্ত)
--
টীকাঃ
১. এ হাদীসটি সুনানে আবী দাউদ, সহীহ মুসলিম, সুনানে ইবনে মাজাহ এবং সুনানে নাসাঈর মধ্যেও বর্ণিত হয়েছে।
. এটা হাফিয আবু বকর বারকানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
. এ হাদীসটি আবু বকর ইবনে আবী দাউদ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
. উটের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করার আদেশকরণের কারণ এই যে, এই জন্তুর পানাহার পদ্ধতি, চালচলন, প্রাকৃতিক ক্রিয়া, সঙ্গম, প্রণালী, বসার নিয়ম ইত্যাদি অন্যান্য জন্তু হতে সম্পূর্ণ পৃথক। এই জন্তু একবার পানাহার করলে এক সপ্তাহ আর পানাহারের প্রয়োজন হয় না।
. এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
. এ হাদীসটি হাফিয আবু ইয়ালা (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইবনে দীনার (রঃ) বলেন যে, হযরত ইবনে উমার (রাঃ) এ হাদীসটি তাঁদের সামনে প্রায়ই বর্ণনা করতেন। এ হাদীসের সনদে আবদুল্লাহ ইবনে জাফর নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন যিনি দুর্বল।
. এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) কিতাবুল ঈমানের মধ্যে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) কিতাবুত তাফসীরের মধ্যে বর্ণনা করেছেন।


No comments:

Post a Comment