সূরাঃ ফীল/১০৫, মাক্কী (আয়াতঃ ৫, রুকূঃ ১)



(দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি)।
১। তুমি কি দেখনি যে, তোমার প্রতিপালক হন্তী অধিপতিদের কিরূপ (পরিণতি) করেছিলেন?
২। তিনি কি তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেননি?
৩। তাদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পক্ষীকুল প্রেরণ করেছিলেন।
৪। যারা তাদের উপর প্রস্তর কংকর নিক্ষেপ করেছিল।
৫। অতঃপর তিনি তাদেরকে ভক্ষিত তৃণ সদৃশ করে দেন।
--
আল্লাহ তা'আলা যে কুরায়েশের উপর বিশেষ নিয়ামত দান করেছিলেন, এখানে তারই বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ যে বাহিনী হস্তী সঙ্গে নিয়ে কাবা গৃহ ধ্বংস করার জন্যে অভিযান চালিয়েছিল। তারা কাবা গৃহের অস্তিত্ব মিটিয়ে দেয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাআলা নাম ও নিশানা মিটিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের সর্বপ্রকারের ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। বাহ্যতঃ তারা ছিল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। কিন্তু হযরত ঈসা (আঃ)-এর দ্বীনকে তারা বিকৃত করে ফেলেছিল। তারা প্রায় সবাই মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের অশুভ উদ্দেশ্য এবং তৎপরতা নস্যাৎ করে দেয়া ছিল মূলতঃ মহানবীর () পূর্বাভাষ এবং তাঁর আগমনী সংবাদ। সেই বছরই তাঁর জন্ম হয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ হে কুরায়েশের দল! আবিসিনিয়ার (হাবশের) ঐ বাহিনীর উপর আমি তোমাদেরকে বিজয় দান করেছি, তাতে তোমাদের কল্যাণ সাধন আমার উদ্দেশ্য ছিল না, আমি নিজের গৃহ রক্ষার জন্যেই ঐ বিজয় দান করেছি। আমার প্রেরিত শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ () নবুওয়াতের মাধ্যমে সেই গৃহকে আমি আরো অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করবোমোটকথা, আসহাবে ফীল বা হস্তী অধিপতিদের সংক্ষিপ্ত ঘটনা এটাই যা বর্ণনা করা হলো। 

বিস্তারিত বর্ণনা (اصحاب الاخدود)  এর বর্ণনায় গত হয়েছে যে, হুমায়ের গোত্রের শেষ বাদশাহ নূনুয়াম, যে ছিল মুশরিক, তার সময়ের মুসলমানদেরকে পরিখার মধ্যে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিল। ঐ সব মুসলমান ছিল হযরত ঈসা (আঃ)-এর সত্যিকার অনুসারী। তাঁদের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার। তাঁদের সবাইকে শহীদ করে দেয়া হয়েছিল। দাউস যু সালাবান নামক একটি মাত্র লোক বেঁচেছিলেন। তিনি সিরিয়ায় পৌঁছে রোমের বাদশাহ কায়সারের কাছে ফরিয়াদ করলেন। কায়সার ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। তিনি হাবশের (আবিসিনিয়ার) বাদশাহ নাজাশীকে লিখলেনঃদাউস যু সা'লাবানের সঙ্গে পুরো বাহিনী পাঠিয়ে দিন। সেখান থেকে শক্রদেশ নিকটবর্তী ছিল। বাদশাহ নাজাশী আমীর ইবনে ইরবাত ও আবরাহা ইবনে সাহাব আবু ইয়াকসুমকে সৈন্য পরিচালনার যৌথ দায়িত্ব দিয়ে এক বিরাট সেনাবাহিনী যুনুয়াসের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই সৈন্যদল ইয়ামনে পৌঁছলো এবং ইয়ামন ও তথাকার অধিবাসীদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করলোশূনুয়াস পালিয়ে গেল এবং সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণ করলোযুনুয়াসের শাসন ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার পর সমগ্র ইয়ামন হাবশের বাদশাহর কর্তৃত্বে চলে গেল। সৈন্যাধ্যক্ষ হিসেবে আগমনকারী উভয় সর্দার ইয়ামনে বসবাস করতে লাগলোকিন্তু অল্প কিছুদিন পরই তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলোশেষ পর্যন্ত। উভয়ে নিজ নিজ বিভক্ত সৈন্যদলসহ মুখোমুখী সংঘর্ষের জন্যে প্রস্তুত হলোযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে উভয় সর্দার পরস্পরকে বললোঃ অযথা রক্তপাত করে কি লাভ, চলো আমরা উভয়ে লড়াই করি। যে বেঁচে যাবে, ইয়ামন এবং সেনাবাহিনী তার অনুগত থাকবে।এই কথা অনুযায়ী উভয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হলোআমীর ইবনে ইরবাত আবরাহার উপর আক্রমণ করলো এবং তরবারীর এক আঘাতে তার চেহারা রক্তাক্ত করে ফেললোনাক, ঠোট এবং চেহারার বেশ কিছু অংশ কেটে গেল। এই অবস্থা দেখে আবরাহার ক্রীতদাস আতৃদাহ্ এক অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ইরবাতকে হত্যা করে ফেললোমারাত্মকভাবে আহত আবরাহা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরে গেল। বেশ কিছু দিন চিকিৎসার পর তার ক্ষত ভাল হলো এবং সে ইয়ামনের শাসনকর্তা হয়ে বসলোআবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজাশী এ খবর পেয়ে খুবই ক্রুদ্ধ হলেন এবং একপত্রে জানালেনঃআল্লাহর কসম! আমি তোমার শহরসমূহ ধ্বংস করবো এবং তোমার টিকি কেটে আনবোআবরাহা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এ পত্রের জবাব লিখলো এবং দূতকে নানা প্রকারের উপঢৌকন, একটা থলের মধ্যে ইয়ামনের মাটি এবং নিজের মাথার কিছু চুল কেটে ওর মধ্যে রাখলো ও ওর মুখ বন্ধ করে দিলোতাছাড়া চিঠিতে সে নিজের অপরাধের ক্ষমা চেয়ে লিখলোঃইয়ামনে মাটি এবং আমার মাথার চুল হাযির রয়েছে, আপনি নিজের কসম পূর্ণ করুন এবং আমার অপরাধ। ক্ষমা করে দিন!এতে নাজাশী খুশী হলেন এবং ইয়ামনের শাসনভার আবরাহাকে লিখে দিলেন। তারপর আবরাহা নাজাশীকে লিখলোঃআমি ইয়ামনে আপনার জন্যে এমন একটি গীর্জা তৈরি করছি যে, এরকম গীর্জা ইতিপূর্বে পৃথিবীতে কখনো তৈরি হয়নি। অতি যত্ন সহকারে খুবই মযবুত ও অতি উঁচু করে ঐ গীর্জাটি নির্মিত হলোঐ গীর্জার চূড়া এতো উঁচু ছিল যে, চূড়ার প্রতি টুপি মাথায় দিয়ে তাকালে মাথার টুপি পড়ে যেতোআরববাসীরা ঐ গীর্জার নাম দিয়েছিল কালীসঅর্থাৎ টুপি ফেলে দেয়া গীর্জা। এবার আবরাহা মনে করলো যে, জনসাধারণ কাবায় হজ্ব না করে বরং এ গীর্জায় এসে হজ্ব করবে। সারাদেশে সে এটা ঘোষণা করে দিলোআদনানিয়্যাহ ও কাহতা নিয়্যাহ গোত্র এ ঘোষণায় খুবই অসন্তুষ্ট, আর কুরায়েশরা ভীষণ রাগান্বিত হলোঅল্প কয়েকদিন পরে দেখা গেল যে, এক ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে ঐ গীর্জায় প্রবেশ করে পায়খানা করে এসেছে। প্রহরীরা পরের দিন এ অবস্থা দেখে বাদশাহর কাছে খবর পাঠালো এবং অভিমত ব্যক্ত করলো যে, কুরায়েশরাই এ কাজ করেছে। তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে বলেই এ কাণ্ড তারা করেছে। আবরাহা তৎক্ষণাৎ কসম করে বললোঃআমি মক্কার বিরুদ্ধে অভিযান চালাবো এবং বায়তুল্লাহর প্রতিটি ইট পর্যন্ত খুলে ফেলবো

 অন্য এক বর্ণনায় এরূপও আছে যে, কয়েকজন উদ্যোগী কুরায়েশ যুবক ঐ গীর্জায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই দিন বাতাস প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত হয়েছিল বলে আগুন ভালভাবে ঐ গীর্জাকে গ্রাস করেছিল এবং ওটা মাটিতে ধ্বসে পড়েছিল। অতঃপর ক্রুদ্ধ আবরাহা এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলোতাদের সাথে এক বিরাট উঁচু ও মোটা হাতী ছিল। ঐরূপ হাতী ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। হাতীটির নাম ছিল মাহমুদ। বাদশাহ নাজাশী মক্কা অভিযান সফল করার লক্ষ্যে ঐ হাতিটি আবরাহাকে দিয়েছিল। ঐ হাতীর সাথে আবরাহা আরো আটটি অথবা বারোটি হাতী নিলোতার উদ্দেশ্য ছিল যে, সে বায়তুল্লাহর দেয়ালে শিকল বেঁধে দিবে, তারপর সমস্ত হাতীর গলায় ঐ শিকল লাগিয়ে দিবে। এতে শিকল টেনে হাতীগুলো সমস্ত দেয়াল একত্রে ধ্বসিয়ে দিবে। মক্কার অধিবাসীরা এ সংবাদ পেয়ে দিশাহারা হয়ে পড়লোযে কোন অবস্থায় এর মুকাবিলা করার তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলোযুনফর নামক ইয়ামনের একজন রাজ বংশীয় লোক নিজের গোত্র ও আশে পাশের বহু সংখ্যক আরবকে একত্রিত করে দুবৃত্ত আবরাহার মুকাবিলা করলেন। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। যুনফর পরাজিত হলেন এবং আবরাহার হাতে বন্দী হলেন। যুনফরকেও সঙ্গে নিয়ে আবরাহা মক্কার পথে অগ্রসর হলোখাশআম গোত্রের এলাকায় পৌঁছার পর নুফায়েল ইবনে হাবীব আশআমী একদল সৈন্য নিয়ে আবরাহার মুকাবিলা করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তাঁরাই আবরাহার হাতে পরাজয় বরণ করলেন। নুফায়েলকেও যুনফরের মত বন্দী করা হলোআবরাহা প্রথম নুফায়েলকে হত্যা করার ইচ্ছা করলো, কিন্তু পরে মক্কার পথ দেখিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে জীবিতাবস্থায় সঙ্গে নিয়ে চললোতায়েফের উপকণ্ঠে পৌঁছলে সাকীফ গোত্র আবরাহার সাথে সন্ধি করলো যে, লাত মূর্তিটি যে প্রকোষ্ঠে রয়েছে, আবরাহার সৈন্যরা ঐ প্রকোষ্ঠের কোন ক্ষতি সাধন করবে না। সাকীফ গোত্র আবু রিগাল নামক একজন লোককে পথ দেখিয়ে দেয়ার জন্যে আবরাহার সঙ্গে দিলোমক্কার কাছে মুগমাস নামক স্থানে তারা অবস্থান করলোআবরাহার সৈন্যেরা আশেপাশের জনপদ এবং চারণভূমি থেকে বহু সংখ্যক উট এবং অন্যান্য পশু দখল করে নিলোএগুলোর মধ্যে আবদুল মুত্তালিবের দুশ উটও ছিল। এতে আরবের কবিরা আবরাহার নিন্দে করে কবিতা রচনা করলো সীরাতে ইবনে ইসহাকে ঐ কবিতার উল্লেখ রয়েছে।

 অতঃপর আবরাহা নিজের বিশেষ দূত হানাতাহ হুমাইরীকে বললোঃ তুমি মক্কার সর্বাপেক্ষা বড় সর্দারকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসোএবং ঘোষণা করে দাওঃ আমরা মক্কাবাসীদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি, আল্লাহর ঘর ভেঙ্গে ফেলাই শুধু আমাদের উদ্দেশ্য। তবে হ্যা, মক্কাবাসীরা যদি কাবাগৃহ রক্ষার জন্যে এগিয়ে আসে এবং আমাদেরকে বাধা দেয় তাহলে বাধ্য হয়ে আমাদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। হানাতাহ মক্কার জনগণের সাথে আলোচনা করে বুঝতে পারলো যে, আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশেমই মক্কার বড় নেতা। হানাতাহ আবদুল মুত্তালিবের সামনে আবরাহার বক্তব্য পেশ করলে আবদুল মুত্তালিব বললেনঃআল্লাহর কসম! আমাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছাও নেই এবং যুদ্ধ করার মত শক্তিও নেই।আল্লাহর সম্মানিত ঘর। তাঁর প্রিয় বন্ধু হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জীবন্ত স্মৃতি। সুতরাং আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিজের ঘরের হিফাজত নিজেই করবেন। অন্যথায় তার ঘরকে রক্ষা করার সাহসও আমাদের নেই এবং যুদ্ধ করার মত শক্তিও আমাদের নেই।হানাতাহ তখন তাকে বললোঃঠিক আছে, আপনি আমাদের বাদশাহর কাছে চলুন।আবদুল মুত্তালিব তখন তার সাথে আবরাহার কাছে গেলেন। আবদুল মুত্তালিব ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শণ বলিষ্ঠ দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। তাঁকে দেখা মাত্র যে কোন মানুষের মনে শ্রদ্ধার উদ্রেক হতোআবরাহা তাঁকে দেখেই সিংহাসন থেকে নেমে এলো এবং তার সাথে মেঝেতে উপবেশন করলোঃ সে তার দোভাষীকে বললোঃ তাকে জিজ্ঞেস করঃ তিনি কি চান? আবদুল মুত্তালিব জানালেনঃবাদশাহ আমার দুশ উট লুট করিয়েছেন। আমি সেই উট ফেরত নিতে এসেছি।বাদশাহ আবরাহা তখন দো-ভাষীর মাধ্যমে তাঁকে বললোঃ প্রথম দৃষ্টিতে আপনি যে শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন, আপনার কথা শুনে সে শ্রদ্ধা লোপ পেয়ে গেছে। নিজের দুশ উটের জন্যে আপনার এতো চিন্তা অথচ স্বজাতির ধর্মের জন্যে কোন চিন্তা নেই! আমি আপনাদের ইবাদতখানা কা'বা ধ্বংস করে ধূলিসাৎ করতে এসেছি।একথা শুনে আবদুল মুত্তালিব জবাবে বললেনঃশুন, উটের মালিক আমি, তাই উট ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে এসেছি। আর কাবাগৃহের মালিক হলেন স্বয়ং আল্লাহ। সুতরাং তিনি নিজেই নিজের ঘর রক্ষা করবেন।তখন ঐ নরাধম বললোঃআজ স্বয়ং আল্লাহও কাবাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন না।একথা শুনে আবদুল মুত্তালিব বললেনঃতা আল্লাহ জানেন এবং আপনি জানেন।এও বর্ণিত আছে যে, মক্কার জনগণ তাদের ধন সম্পদের এক তৃতীয়াংশ আবরাহাকে দিতে চেয়েছিল, যাতে সে এই ঘৃণ্য অপচেষ্টা হতে বিরত থাকে। কিন্তু আবরাহা তাতেও রাজী হয়নি। মোটকথা, আবদুল মুত্তালিব তাঁর উটগুলো নিয়ে ফিরে আসলেন এবং মক্কাবাসীদেরকে বললেনঃতোমরা মক্কাকে সম্পূর্ণ খালি করে দাও। সবাই তোমরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নাও।" তারপর আবদুল মুত্তালিব কুরায়েশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে কা'বা গৃহে গিয়ে কাবার খুঁটি ধরে দেয়াল ছুঁয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করলেন এবং কায়মনোবাক্যে ঐ পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ গৃহ রক্ষার জন্যে প্রার্থনা করলেন। আবরাহা এবং তার রক্ত পিপাসু সৈন্যদের অপবিত্র ইচ্ছার কবল থেকে কাবাকে পবিত্র রাখার জন্যে আবদুল মুত্তালিব কবিতার ভাষায় নিম্নলিখিত দুআ করেছিলেনঃ

اللهم ان ابمر ءيم * نع رحله فا منع رجلك
لا يغابن صليبهم * ومحالهم ابدا محالك

অর্থাৎআমরা নিশ্চিন্ত, কারণ আমরা জানি যে, প্রত্যেক গৃহমালিক নিজেই নিজের গৃহের হিফাযত করেন। হে আল্লাহ! আপনিও আপনার গৃহ আপনার শক্রদের কবল হতে রক্ষা করুন। আপনার অস্ত্রের উপর তাদের অস্ত্র জয়যুক্ত হবে এমন যেন কিছুতেই না হয়। অতঃপর আবদুল মুত্তালিব কা'বা গৃহের খুঁটি ছেড়ে দিয়ে তাঁর সঙ্গীদেরকে নিয়ে ওর আশে পাশের পর্বতসমূহের চূড়ায় উঠে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। এমনও বর্ণিত আছে যে, কুরবানীর একশত পশুকে নিশান লাগিয়ে কাবার আশে পাশে ছেড়ে দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যদি দুবৃত্তরা আল্লাহর নামে ছেড়ে দেয়া পশুর প্রতি হাত বাড়ায় তাহলে আল্লাহর গযব তাদের উপর অবশ্যই নেমে আসবে।

পরদিন প্রভাতে আবরাহার সেনাবাহিনী মক্কায় প্রবেশের উদ্যোগ আয়ােজন করলোবিশেষ হাতী মাহমুদকে সজ্জিত করা হলোপথে বন্দী হয়ে আবরাহার সাথে আগমনকারী নুফায়েল ইবনে হাবীব তখন মাহমুদ নামক হাতীটির কান ধরে বললেনঃমাহমুদ! তুমি বসে পড়, আর যেখান থেকে এসেছে সেখানে ভালভাবে ফিরে যাও। তুমি আল্লাহর পবিত্র শহরে রয়েছে।একথা বলে নুফায়েল হাতির কান ছেড়ে দিলেন এবং ছুটে গিয়ে নিকট এক পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করলেন। মাহমুদ নামক হাতীটি নুফায়েলের কথা শোনার সাথে সাথে বসে পড়লোবহুচেষ্টা করেও তাকে নড়ানো সম্ভব হলো না। পরীক্ষামূলক ভাবে ইয়ামনের দিকে তার মুখ ফিরিয়ে টেনে তোলার চেষ্টা করতেই হাতী তাড়াতাড়ি উঠে দ্রুত অগ্রসর হতে লাগলোপূর্বদিকে চালাবার চেষ্টা করা হলে সেদিকেও যাচ্ছিল, কিন্তু মক্কা শরীফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চালাবার চেষ্টা করতেই বসে পড়লোসৈন্যরা তখন হাতীটিকে প্রহার করতে শুরু করলোএমন সময় দেখা গেল এক ঝাঁক পাখি কালো মেঘের মত হয়ে সমুদ্রের দিক থেকে উড়ে আসছে। চোখের পলকে ওগুলো আবরাহার সেনাবাহিনীর মাথার উপর এসে পড়লোএবং চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘিরে ফেললোপ্রত্যেক পাখির চঞ্চুতে একটি এবং দুপায়ে দুটি কংকর ছিল। কংকরের ঐটুকরাগুলো ছিল মসুরের ডাল বা মাস কলাই এর সমান। পাখিগুলো কংকরের ঐ টুকরোগুলো আবরাহার সৈন্যদের প্রতি নিক্ষেপ করছিল। যার গায়ে ঐ কংকর পড়ছিল সেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ভবলীলা সাঙ্গ করছিল। সৈন্যরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছিল আর নুফায়েল নুফায়েল বলে চীৎকার করছিল কারণ তারা তাঁকেই পথ প্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে এনেছিল। নুফায়েল তখন পাহাড়ের শিখরে আরোহণ করে অন্যান্য কুরায়েশদের সাথে আবাহা ও তার সৈন্যদের দুরাবস্থার দৃশ্য অবলোকন করছিলেন। ঐ সময় নুফায়েল নিম্নলিখিত কবিতাংশ পাঠ করছিলেনঃ

این المفر و الإله الطايب * والأشم المغلوب تي الغايب

অর্থাৎএখন আর আশ্রয়স্থল কোথায়? স্বয়ং আল্লাহই তো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। শোন, দুবৃত্ত আশরম পরাজিত হয়েছে, জয়ী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে নুফায়েল আরো বলেনঃ

الاحييت عنايا ودينا *
 نعمناکم منع الاصباح عينا ودينة لورأيت ولانريه *
 لدى جنب المحصب مارأينا ان العذرتی وحمدت امری *
 ولم تأسي على مافات بينا
حمدت الله اذا ابصرت طیرا * 
وخفت حجارة تلقى علينا فكل القوم تسئل على نفیل *
 كأن على الحبشان دینا

অর্থাৎহাতী ওয়ালাদের দুরাবস্থার সময়ে তুমি যদি উপস্থিত থাকতে! মুহাসসাব প্রান্তরে তাদের উপর আযাবের কংকর বর্ষিত হয়েছে। তুমি সে অবস্থা দেখলে আল্লাহর দরবারে সিজদায় পতিত হতে। আমরা পাহাড়ের উপর দাড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করছিলাম। আমাদের হৃৎপিণ্ড কাঁপছিল এই ভয়ে যে, না জানি হয় তো আমাদের উপরও এই কংকর পড়ে যায় এবং আমাদেরও দফারফা করে দেয়। পুরো সম্প্রদায় মুখ ফিরিয়ে পালাচ্ছিল ও নুফায়েল নুফায়েল বলে চীঙ্কার করছিল, যেন নুফায়েলের উপর হাবশীদের ঋণ রয়েছে।

ওয়াকেদী (রঃ) বলেন যে, পাখিগুলো ছিল সবুজ রঙএর। ওগুলো কবুতরের চেয়ে কিছু ছোট ছিল। ওদের পায়ের রঙছিল লাল। অন্য এক রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, মাহমুদ নামক হাতীটি যখন বসে পড়লো এবং সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে উঠানো সম্ভব হলো না। তখন সৈন্যরা অন্য একটি হাতীকে সামনের দিকে নেয়ার চেষ্টা করলোকিন্তু সে পা বাড়াতেই তার মাথায় কংকরের টুকরো পড়লো এবং আর্তনাদ করে পিছনে সরে এলোঅন্যান্য হাতীও তখন এলোপাতাড়ি ছুটতে শুরু করলোকয়েকটির উপর কংকর পড়ায় তৎক্ষণাৎ ওগুলো মারা গেল। যারা ছুটে পালাচ্ছিল তাদেরও এক একটি অঙ্গ খসে খসে পড়ছিল। এবং অবশেষে সবগুলোই মারা গেল। আবরাহা বাদশাহও ছুটে পালালো, কিন্তু তারও এক একটি অঙ্গ খসে খসে পড়ছিল। সানআ (তৎকালীন ইয়ামনের রাজধানী) নামক শহরে পৌঁছার পর সে মাংসপিণ্ডে পরিণত হলো এবং কুকুরের মত ছটফট করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করলোতার কলেজা ফেটে গিয়েছিল। কুরায়েশরা প্রচুর ধন সম্পদ পেয়ে গিয়েছিল। আবদুল মুত্তালিব তো সোনা সংগ্রহ করে করে একটি কূপ ভর্তি করেছিলেন। ঐ বছরই সারা দেশে প্রথম ওলা ওঠা এবং প্লেগ রোগ দেখা দেয়। হরযল, হানযাল প্রভৃতি কটুগাছও ঐ বছর উৎপন্ন হয়। আল্লাহ তা'আলা তার নবী ()-এর ভাষায় এ নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন এবং যেন বলছেনঃ যদি তোমরা আমার ঘরের সম্মান এভাবে করতে থাকতে এবং আমার রাসূল ()-এর কথা মানতে তবে আমিও সেভাবে তোমাদের হিফাযত করতাম এবং শত্রু দল থেকে তোমাদেরকে মুক্তি দিতাম।

(أَبَابِيلَ) শব্দটি বহুবচন, এর একবচন আরবী অভিধানে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর (سِجِّيلٍ) শব্দের অর্থ হলো খুবই কঠিন বা শক্ত। কোন কোন তাফসীরকার। বলেন যে, (أَبَابِيلَ) এবং (سِجِّيلٍ) শব্দ দুটি ফারসী শব্দ।(سِجِّيلٍ)এর অর্থ হলো প্রস্তর সমন্বিত মৃত্তিকা।(عصف) ' শব্দটি (عصفة) শব্দের বহুবচন। (عصف) মাঠের ফসলের ঐ সব পাতাকে বলা হয় যেগুলো এখনো পাকেনি। (طَيْرًا أَبَابِيلَ) এর অর্থ হলো ঝাঁঝাঁক পাখী, বহুসংখ্যক এবং ক্রমাগত আগমনকারী। কোন কোন ব্যাকরণবিদ বলেন যে, (أَبَابِيلَ) শব্দটি (ابيل) শব্দের বহুবচন।

হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন যে, ঐ পাখিগুলোর চঞ্চু ছিল পাখির মত এবং নখ ছিল কুকুরের মত।

ইকরামা (রঃ) বলেন যে, সবুজ রঙ-এর এই পাখিগুলো সমুদ্র হতে বের হয়ে এসেছিল। ওগুলোর মাথা ছিল জন্তুর মত। এ সম্পর্কে আরো বহু উক্তি রয়েছে। পাখির ঝাঁক আবরাহার সৈন্যদের মাথার উপর অবস্থান করে চীৎকার করছিল এবং কংকর নিক্ষেপ করছিল। যার মাথায় ঐ কংকর পড়ছিল তা তার পায়খানার দ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঐ ব্যক্তি দ্বিখণ্ডিত হয়ে লুটিয়ে পড়ছিল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে প্রবল বাতাস বইতে লাগলোএর ফলে আশে পাশের বালুকণা এসে তাদের চোখে পড়লো এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই তাদেরকে ঘায়েল করে ফেললো

(عصف) এর অর্থ হলো ভূষি এবং (مَّأْكُولٍ) অর্থহলো ভক্ষিত বা টুকরো টুকরো কৃত।

হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন যে, শস্যদানার উপরের ভূষিকে (عصف) বলা হয়। হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, (عصف) হলো ক্ষেতের শস্যের ঐ পাতা যেগুলো পশুরা খেয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকে তছনছ করে দিলেন এবং সবাইকে ধ্বংস করে দিলেন। তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলোকোন কল্যাণই তারা লাভ করতে সমর্থ হলো না। তাদের দুরাবস্থার খবর অন্যদেরকে পৌছানোর মত কেউই তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল অল্পসংখ্যক যারা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বেঁচেছিল তারাও পরে ধুকে ধুকে মরেছিল। স্বয়ং বাদশাহ্ও এক টুকরো গোশতের মত হয়ে গিয়েছিল। কোনক্রমে সে সানআতে পৌছলোসেখানে পৌছেই তার কলেজা ফেটে গেল এবং সে মারা গেল। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াকস্ ইয়ামনের শাসন ভার গ্রহণ করলোতারপর তার অন্য ভাই মাসরুক ইবনে আবরাহা সিংহাসনে আরোহন করলোএ সময়ে ঘূইয়াযান হুমাইরী কিসরার (পারস্য সম্রাট) কাছে গিয়ে হাবশীদের কবল থেকে ইয়ামনকে মুক্ত করার জন্যে সাহায্য প্রার্থনা করলোকিসরা সাইফের সাথে একদল বাহাদুর সৈন্য পাঠালোসেই সৈন্যদল হাবশীদেরকে পরাজিত করে আবরাহার বংশধরদের কবল থেকে ইয়ামনের শাসনক্ষমতা কেড়ে নেয়। অতঃপর হুমাইরীয় গোত্র ইয়ামন শাসন করতে থাকে। আরবের লোকেরা এই উপলক্ষে উৎসব পালন করেচারদিক থেকে হুমাইরীয় গোত্রের বাদশাকে অভিনন্দন জানানো হয়।

হযরত আয়েশা বিনতে আবী বকর (رضي الله عنه) বলেনঃআবরাহার সৈন্যদলের দুজন সৈন্যকে আমি মক্কা শরীফে দেখেছি। তারা উভয়েই অন্ধ এবং চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। তারা বসে বসে ভিক্ষা করতো

হযরত আসমা বিনতে আবী বকর (رضي الله عنه) বলেন যে, যে আসাফ ও নায়েলা নামক মূর্তিদ্বয়ের পার্শ্বে মুশরিকরা কুরবানী করতো সেখানে বসে ঐ লোক দু'টি লোকদের কাছে ভিক্ষা চাইতোতাদের মধ্যে একজন ছিল হাতীর চালক, যার নাম ছিল আনীসা। কোন কোন ইতিহাস গ্রন্থে লিখিত রয়েছে যে, আবরাহা নিজে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেনি, বরং শামর ইবনে মাকসূত নামক এক ব্যক্তির নেতৃত্বাধীনে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিল। সৈন্যসংখ্যা ছিল বিশ হাজার। পাখিগুলো তাদের উপর রাত্রিকালে এসেছিল এবং সকাল পর্যন্ত তাদের সকলকে তছনছ করে ফেলেছিল। কিন্তু এ রিওয়াইয়াতটি গারীব বা দুর্বল। আসল কথা হলো এই যে, স্বয়ং বাদশাহ্ আবরাহা আশরম হাবশী নিজেই সৈন্যদল নিয়ে এ অভিযানে অংশ নিয়েছিল। শামর ইবনে মাকসূদ হয় তো কোন একদল সৈন্যের সেনাপতি ছিল। বহু সংখ্যক আরব কবি এ ঘটনাকে নানাভাবে তাঁদের কবিতায় বর্ণনা করেছেন।

একটি রিওয়াইয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হুদাইবিয়ার সন্ধির দিনে নবী করীম () একটি টিলার উপর উঠেছিলেন। সেখান থেকে কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর উস্ত্রীটি সেখানে বসে পড়েছিল। সাহাবী (رضي الله عنه)গণ বহু চেষ্টা করেও উষ্ট্ৰীকে উঠাতে পারলেন না। তখন তারা বললেন যে, উষ্ট্রী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাসূলুল্লাহ্ () বললেনঃনা, সে ক্লান্তও হয়নি এবং বসে পড়া তার অভ্যাসও নয়। তাকে ঐ আল্লাহ্ থামিয়ে দিয়েছেন যিনি হাতীকে থামিয়ে দিয়েছিলেন, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! মক্কাবাসীরা যে শর্তে সম্মত হবে আমি সেই শর্তেই তাদের সাথে সন্ধি করবোতবে, আল্লাহর অমর্যাদা হতে পারে এমন কোন শর্তে আমি সম্মত হবো না।তারপর তিনি উস্ত্রীকে ধমক দেয়া মাত্রই সে উঠে দাঁড়ালোএ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে।

সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ () বলেনঃআল্লাহ্ তা'আলা মক্কার উপর হাতী ওয়ালাদের আধিপত্য বিস্তার করতে দেননি, বরং তিনি তাঁর নবী () ও ঈমানদার বান্দাদেরকে মক্কার উপর আধিপত্য দান করেছেন। জেনে রেখো যে, মক্কার মর্যাদা আজ ঐ অবস্থাতেই ফিরে এসেছে যে অবস্থায় গতকাল ছিল খবরদার! প্রত্যেক উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তিদের নিকট (খবর) পৌছিয়ে দিবে।

(সূরাঃ ফীল এর তাফসীর সমাপ্ত)



No comments:

Post a Comment